চট্টগ্রামের অপরাধ জগতে এক পরিচিত নাম সাজ্জাদ, যিনি একসময়ের মুরগির দোকানের কর্মচারী থেকে আজ শীর্ষ সন্ত্রাসী রূপে পরিচিত। তার স্ত্রী তামান্না শারমিনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সমানভাবে আলোচিত, বরং কিছু ক্ষেত্রে তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য জনমনে আরও বেশি উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এই দম্পতির উত্থান এবং তাদের ভয়ঙ্কর জীবনযাত্রা এখন চট্টগ্রামের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
সাজ্জাদের জীবনের শুরুটা ছিল অভাব আর কষ্টে ভরা। শৈশবে মাকে হারানোর পর তিনি নজু মিয়ারহাট এলাকায় একটি মুরগির দোকানে কাজ করতেন। সেই পরিবেশে কর্মরত অবস্থাতেই তার অপরাধ জগতে হাতেখড়ি হয়। তিনি কুখ্যাত সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খানের ছত্রছায়ায় প্রবেশ করে ধীরে ধীরে অন্ধকার জগতের বাসিন্দা হয়ে ওঠেন। এক সময়ের চাঁদাবাজি, জমি দখল এবং মারামারির মতো অপরাধে জড়িত সাজ্জাদ অল্প দিনেই স্থানীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।
দীর্ঘদিন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে থাকার পর অবশেষে ২০২৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া এলাকায় সাজ্জাদের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের নেত্রী শিলা, যিনি স্টেজ শো করার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
সাজ্জাদের বর্তমান স্ত্রী তামান্না শারমিন পেশায় একজন নৃত্যশিল্পী। দুবাইতে বিভিন্ন নাইট ক্লাবে কাজ করার সময় সাজ্জাদের সাথে তার পরিচয় হয়। মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে তাদের সম্পর্কের সূচনা হলেও, ২০২৪ সালের প্রথম দিকে তাদের সম্পর্ক নতুন করে দানা বাঁধে। এরপর তারা রাউজানের একটি মসজিদে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এটি ছিল তামান্নার তৃতীয় এবং সাজ্জাদের দ্বিতীয় বিবাহ।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, পূর্বের স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে তামান্না সাজ্জাদকে বিয়ে করার পর শুধু একজন সমাজকর্মী হিসেবেই পরিচিত হননি, বরং তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।
২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় সাজ্জাদ প্রকাশ্যে দুই ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যান এবং রাউজানে আত্মগোপন করেন। এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের পর তামান্না তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন মহলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন এবং এমনকি হুমকিও দেন। তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য, “আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে সাজ্জাদকে জামিন করাব,” জনমনে আরও ভীতির সঞ্চার করে।
সম্প্রতি, সাজ্জাদ এবং তামান্না দুজনে মিলে ২০ লাখ টাকা ঘুষের প্রস্তাব দিয়ে পুলিশের কাছ থেকে সাজ্জাদকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে কর্তব্যনিষ্ঠ পুলিশ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং সাজ্জাদকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে সোপর্দ করে। গ্রেফতারের পরও তামান্না ফেসবুকে লাইভে এসে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করেন, “এগুলো নিয়ে দুঃখ প্রকাশের কিছু নেই, আমার জামাই বীরের মতো ফিরে আসবে।”
এই ঘটনা একদিকে যেমন তাদের ক্ষমতার দাপট প্রদর্শন করে, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে তোলে। সাজ্জাদ এবং তামান্না এখনও তাদের অপরাধমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে চট্টগ্রামে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সাজ্জাদ ও তার দলের এতটাই প্রভাব যে, নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করতে গেলেও তাদের কাছে চাঁদা দিতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
সাজ্জাদ ও তামান্নার জীবনযাত্রা সমাজের অন্ধকার দিক এবং অপরাধ জগতের ক্ষমতা বিস্তারের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। এই দম্পতির অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড শুধু চট্টগ্রাম নয়, বরং পুরো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের গ্রেফতার এবং বিচার প্রক্রিয়া দেশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।

Discussion about this post