ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের নাগপুর শহরে এক অপ্রত্যাশিত ও উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে। সোমবার (১৭ মার্চ) রাত থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষ ব্যাপক পাথর নিক্ষেপ করে এবং বেশ কিছু দোকান ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে বাধ্য হয় এবং পরবর্তীতে স্থানীয় প্রশাসন কারফিউ জারি করে।
ভারতের অন্যতম প্রধান সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা জানায়, নাগপুর শহরের মহাল এলাকায় সোমবার সন্ধ্যায় এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দিকেও ব্যাপক পরিমাণে পাথর ছুঁড়ে মারে।
প্রাথমিক তথ্যানুসারে, এই ঘটনায় ছয়জন সাধারণ নাগরিক ও তিনজন পুলিশ অফিসার আহত হয়েছেন। এরপর দ্রুত এই সংঘর্ষ কোতোয়ালি এবং গণেশপেঠ এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় এক হাজার মানুষ ব্যাপক ভাঙচুর ও পাথর নিক্ষেপে লিপ্ত হয়। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে, বহু দোকানপাট ও ব্যক্তিগত গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) ভোর পর্যন্ত পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে অন্তত ২০ জন সন্দেহভাজনকে আটক করেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সোমবার দুপুরে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কবর সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দল নাগপুরের মহাল এলাকায় একটি প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। ওই বিক্ষোভে আওরঙ্গজেবের একটি প্রতিকৃতিও পোড়ানো হয়।
উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি সম্ভাজিনগর জেলার খুলদাবাদে অবস্থিত আওরঙ্গজেবের কবরস্থান সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। পিটিআই পুলিশের সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, এই বিক্ষোভ চলাকালে কোরআন পোড়ানো হয়েছে বলে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে এই সংক্রান্ত একটি অভিযোগও পুলিশের কাছে নথিভুক্ত করা হয়েছে।
তবে, মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মন্ত্রী যোগেশ কদম সংবাদ সংস্থা এএনআইকে জানিয়েছেন, এই সহিংসতার প্রকৃত কারণ এখনও পর্যন্ত স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। তিনি আরও জানান, এই ঘটনায় ৪৭ জনকে আটক করা হয়েছে এবং মঙ্গলবার সকালের দিকে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে, সংঘাতপূর্ণ এলাকায় এখনও কারফিউ জারি রয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, যে মহাল অঞ্চলে সংঘর্ষ ছড়িয়েছিল, সেই এলাকা ব্যতীত শহরের অন্যান্য অংশে জনজীবন স্বাভাবিক রয়েছে। তবে, পুলিশ নাগরিকদের অপ্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বের না হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, যে মহাল এলাকায় সোমবার রাত থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত, সেটি হিন্দু পুনরুত্থানবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর প্রধান কার্যালয়ের খুব কাছেই অবস্থিত। এমনকি মহারাষ্ট্রের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডনবিশের বাড়িও এই নাগপুর শহরেই।
নাগপুর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার অর্চিত চন্দক এএনআইকে বলেছেন, একটি ভিত্তিহীন গুজবের ফলেই সোমবারের ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। কিছু ভুল তথ্যের কারণে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি সকলের কাছে অনুরোধ জানান, কেউ যেন ঘর থেকে বের না হন, পাথর নিক্ষেপ না করেন এবং কোনো প্রকার গুজবে কান না দেন।
অন্যদিকে, নাগপুর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকরিও এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য গুজবকে দায়ী করেছেন। নিজের এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লিখেছেন, কিছু ভিত্তিহীন গুজবের কারণেই নাগপুরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, শান্তি বজায় রাখা এই শহরের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য এবং তিনি সকলের কাছে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য আবেদন জানান।
এআইএমআইএম নেতা ও প্রাক্তন বিধায়ক ওয়ারিস পাঠান এই সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নাগপুরে অগ্নিসংযোগ ও পাথর নিক্ষেপের ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং সকলের উচিত কঠোরভাবে আইন মেনে চলা। তিনি প্রশাসনের কাছে এই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি জানান, যাতে এর পেছনের আসল কারণ উদঘাটিত হয়। পাঠান আরও অভিযোগ করেন যে, গত কয়েকদিন ধরে আওরঙ্গজেবের কবরের বিষয়টি নিয়ে মহারাষ্ট্রে উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে, যাতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে জনগণের দৃষ্টি সরানো যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সোমবার রাতে শহরের চিটনিস পার্ক থেকে শুখরাওয়ারি তালাও রোড পর্যন্ত এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে। এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি চার চাকার গাড়িতে আগুন দেওয়া হয় এবং আবাসিক ভবনগুলোকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করা হয়। এই এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা পিটিআইকে জানিয়েছেন, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে একদল লোক অতর্কিতে তাদের এলাকায় প্রবেশ করে এবং বাড়িগুলোর দিকে পাথর ছুঁড়তে শুরু করে। তারা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং চারটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, যার মধ্যে একটি গাড়ি সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়।
এছাড়াও, হনসাপুরি এলাকাতেও সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। ওই অঞ্চলের এক দোকানদার এএনআইকে জানিয়েছেন, রাত সাড়ে দশটার দিকে তিনি যখন দোকান বন্ধ করছিলেন, তখন হঠাৎ একদল লোককে গাড়িতে আগুন দিতে দেখেন। তিনি জল নিয়ে আগুন নেভাতে গেলে তারা তার মাথায় পাথর ছুঁড়ে মারে। ওই দুষ্কৃতিকারীরা ওই ব্যক্তির দুটি গাড়ি ও কাছাকাছি থাকা আরও কিছু গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
হনসাপুরির আরেক বাসিন্দা এএনআইকে জানিয়েছেন, সহিংসতা শুরুর আগে আক্রমণকারীরা প্রথমে এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো ভেঙে ফেলে। তাদের মুখ ঢাকা ছিল এবং তারা ধারালো অস্ত্র, লাঠি ও কাঁচের বোতল নিয়ে এসেছিল। এসেই তারা দোকানগুলোতে হামলা চালায়, পাথর ছুঁড়তে থাকে এবং গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
আরেকজন বাসিন্দার অভিযোগ, ঘটনার খবর দেওয়ার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল। এই ঘটনা ভারতের মহারাষ্ট্রের নাগপুর শহরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
আরও দেখুনঃ
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।

Discussion about this post