বর্তমান ডিজিটাল যুগে, যখন হাতের মুঠোয় বিশ্ব, তখন প্রতারণার জালও বিস্তার লাভ করেছে অনলাইনে। ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোতে লোভনীয় বিজ্ঞাপনের বন্যা বইয়ে দিয়ে এক শ্রেণির প্রতারক চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের মূল লক্ষ্য? বিদেশে স্বপ্নের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ ও নিরীহ চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া মোটা অঙ্কের টাকা।
আকর্ষণীয় বেতন, বিলাসবহুল জীবন এবং নিরাপদ কর্মসংস্থানের মায়াজাল বিস্তার করে হাজারো মানুষকে বিদেশে পাঠানোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এই চক্র। কিন্তু বাস্তবে? তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ বিপদ। প্রতারণার শিকার হয়ে কেউ বিদেশে শ্রমিক হিসেবে জিম্মি হচ্ছেন, কেউ মানব পাচারের শিকার হচ্ছেন, আবার কেউবা বাধ্য হচ্ছেন অমানবিক ও মানবেতর জীবন যাপন করতে।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ উন্নত জীবনের আশায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য পাড়ি জমান। এই সুযোগটিকেই কাজে লাগাচ্ছে প্রতারক চক্র। পুরোনো কৌশলকে নতুন মোড়কে উপস্থাপন করে, তারা এখন ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্যবহার করছে। তাদের প্রধান টার্গেট সহজ-সরল ও অসচেতন মানুষ।
এক সময় এই চক্র গ্রামে গ্রামে ঘুরে লোক সংগ্রহ করত, কিন্তু এখন তারা অনলাইনে ‘বিশ্বস্ত’ রিক্রুটিং এজেন্সি সেজে বসেছে। লাইসেন্সবিহীন ভুয়া অফিস খুলে ভিসা প্রসেসিং, মেডিকেল পরীক্ষা এবং আকাশ পথের টিকিটের অজুহাতে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, একবার দেশ ছাড়ার পর এজেন্সির সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ থাকে না। তাদের দেওয়া ফোন নম্বরগুলোও হয়ে যায় বন্ধ।
প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিরা যখন বিদেশে পৌঁছান, তখন তারা দেখতে পান বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিশ্রুত চাকরি তো দূরের কথা, থাকার পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক ক্ষেত্রে কাগজপত্র জাল থাকার কারণে তাদেরকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নির্যাতন ও দুর্বিষহ জীবনের শিকার হয়ে অনেকেই পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন, এবং দেশে ফেরার পথ খুঁজছেন। তবে দেশে ফিরে আসলেও তাদের আর্থিক অবস্থা থাকে ভয়াবহ রকমের খারাপ। নিঃস্ব অবস্থায় অনেক পরিবারই তখন দারিদ্র্যের চরম কষাঘাতে জর্জরিত হয়।
জনশক্তি রপ্তানিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ। কিন্তু এই ধরনের প্রতারণা বৈধ অভিবাসন ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (BOESL) জানিয়েছে, সরকারের অনুমোদন ছাড়া যেকোনো এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে যাওয়া চরম ঝুঁকিপূর্ণ। তাই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে BOESL।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি প্রতারক চক্রকে শনাক্ত করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রতারকদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই চক্রকে সম্পূর্ণরূপে থামানো কঠিন। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলে প্রতারণার হার অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। ভুক্তভোগীরা অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিলে প্রতারকদের বিচার করাও সহজ হবে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, বিদেশে চাকরির জন্য আবেদন করার আগে অবশ্যই সরকার অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা যাচাই করা উচিত। কোনো লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখেই তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেওয়া একেবারেই উচিত নয়। প্রতারক চক্রের ফাঁদ থেকে নিজেকে এবং অন্যকে বাঁচাতে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।

Discussion about this post