চট্টগ্রামে এক বিশাল স্বর্ণ চোরাচালান নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই চক্রের মূলহোতাদের ধরতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। সিআইডি’র অনুসন্ধানে বায়েজিদ বোস্তামী ও মধ্যম রামপুরা এলাকা থেকে তিন জন প্রভাবশালী স্বর্ণ চোরাকারবারিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা চোরাচালানের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। শুধু তাই নয়, এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনের সহযোগীর সন্ধানও পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কেউ দুবাইয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন, আবার কেউ এতটাই ধনী যে তার বাড়ি সোনালী রঙে মোড়ানো, যা স্থানীয়দের কাছে ‘গোল্ডেন হাউস’ নামেই পরিচিত।
সিআইডি সূত্র জানায়, বায়েজিদ বোস্তামী থানার উল্টো দিকে অবস্থিত একটি বিলাসবহুল বাড়ির মালিক মো. সাইফুদ্দিন। তার আরও একটি বাড়ি রয়েছে মোহাম্মদ নগর হাউজিং এলাকায়। পাঁচ কাঠা জমির ওপর নির্মিত এই বাড়িটি হালকা সোনালী রঙে রাঙানো। এই বিশেষ রঙের জন্যই স্থানীয়রা বাড়িটিকে ‘গোল্ডেন হাউস’ নামে ডাকে। সিআইডি’র প্রাথমিক হিসেবে, সাইফুদ্দিনের এই দুইটি বাড়ির বাজারমূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা। সিআইডি কর্মকর্তা সুমন সাহা জানান, সাইফুদ্দিনের দৃশ্যমান কোনো পেশা নেই। তবে তার দুই ভাই মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। ধারণা করা হচ্ছে, দুবাই ও ওমান থেকে স্বর্ণবার চোরাচালানের মাধ্যমেই তিনি এই বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
রিয়াজউদ্দিন বাজারের প্যারামাউন্ট সিটি মার্কেটের চতুর্থ তলায় ‘সানজিদা ইলেকট্রনিক্স’ নামক একটি দোকান চালান জাহাঙ্গীর ও সায়েমগীর নামে দুই ভাই। এই দোকানের সাইনবোর্ডে মোবাইল অ্যাক্সেসরিজের ব্যবসার কথা লেখা থাকলেও, সিআইডি জানতে পেরেছে, এর আড়ালে তারা মূলত স্বর্ণ চোরাচালানের কারবার চালান। তদন্তে উঠে এসেছে, এই দুই ভাই দুবাই ও চট্টগ্রামে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। দুবাইয়ে তাদের একটি কসমেটিক্সের ব্যবসাও রয়েছে, যা মূলত স্বর্ণ চোরাচালান ও বিদেশি মুদ্রা পাচারের একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এই সিন্ডিকেটে জাহাঙ্গীর ও সায়েমগীরের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেন পেশাদার চোরাকারবারি মিজানুর রহমান, সোহেল ও হাসেম। সিআইডি’র তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে জাহাঙ্গীর ২৬ বার দুবাই-বাংলাদেশে আসা যাওয়া করেছেন, এবং এর জন্য প্রায় ১০ লাখ টাকা বিমান ভাড়া দিয়েছেন। সায়েমগীর একই সময়ে ১০ বার ভ্রমণ করে ৪ লাখ টাকা খরচ করেছেন। তাদের সহযোগী মিজানুর রহমান ২২ বার এবং সোহেল ৩৭ বার দুবাই-বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন। সিআইডি মনে করে, প্রত্যেকবারই তারা দুবাই থেকে স্বর্ণবার নিয়ে এসেছেন।
২০২১ সালের ২৩শে নভেম্বর, এই সিন্ডিকেটের সদস্য সোহেলকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২ কোটি ৯১ লাখ ১৩ হাজার টাকার স্বর্ণসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে ২৬টি স্বর্ণবার, ৩টি স্বর্ণপিণ্ড, ৬টি স্বর্ণপাত ও কিছু স্বর্ণালংকার জব্দ করা হয়েছিল। সোহেল দুবাই থেকে ফেরার পথে ধরা পড়েছিলেন। সিআইডি’র তদন্তে এটি স্পষ্ট যে, সোহেল এই চক্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. জাহাঙ্গীর ও মো. সাইফুদ্দিন দুজনেই তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জাহাঙ্গীর বলেন, “আমি স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে কোনোভাবেই জড়িত নই। মোবাইল অ্যাক্সেসরিজের ব্যবসা করেই আমি এই সম্পদের মালিক হয়েছি। আমাদের দুই ভাইকে ষড়যন্ত্র করে চোরাচালানকারী বানানো হচ্ছে। ব্যবসার কাজে আমাকে বহুবার দুবাই যেতে হয়েছে।” সাইফুদ্দিনের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও সংক্ষিপ্ত। তিনি বলেন, “আমি কী ব্যবসা করি, সেটা আপনাকে কেন বলতে হবে? আমি কোনো স্বর্ণ চোরাচালান করিনি।”
প্যারামাউন্ট সিটি মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নওশাদ আলম জানান, “জাহাঙ্গীর ও সায়েমগীরকে আমরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ী হিসেবে চিনি। তারা ৭-৮ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছে। তবে তারা যে স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িত, তা আমরা আগে কখনও জানতে পারিনি। সিআইডি’র অভিযানের পরই আমরা বিষয়টি জানতে পারলাম।”
সিআইডি’র তদন্তে আরও উঠে এসেছে, মো. সাইফুদ্দিন দ্রুত ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় স্বর্ণ চোরাচালানের পথ বেছে নিয়েছিলেন। ২০১৭ সালেও তার কাছ থেকে ৩ কোটি টাকার ৬০টি স্বর্ণবার উদ্ধার করা হয়েছিল। সাইফুদ্দিন রাউজানের গহিরা দলই নগরের মৃত ইদ্রিস সওদাগরের পুত্র।
এই তদন্তে স্বর্ণ চোরাচালানের একটি জটিল নেটওয়ার্ক এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পদ অর্জনের কৌশল প্রকাশ পেয়েছে। সিআইডি এখন এই সিন্ডিকেটের অন্যান্য সদস্যদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।

Discussion about this post