রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রবাসীরা বৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ তাদের স্বজনদের কাছে পাঠান, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করে। এই প্রেক্ষাপটে প্রবাসী রেমিট্যান্সকে বৈধ চ্যানেলে আনার জন্য সরকার ১০০ টাকা রেমিট্যান্সে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা প্রদান করে। কিন্তু অনেকেই জানতে চান, এই অতিরিক্ত অর্থ ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী বৈধ কি না।
প্রণোদনার প্রেক্ষাপট
সরকারের এই প্রণোদনার উদ্দেশ্য হলো প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণে উৎসাহিত করা। হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ পাচার রোধ করা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করা।
সরকারি এই প্রণোদনা মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারি রাজস্ব খাতের মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ যে ব্যাংকের মাধ্যমে আসুক না কেন, এই প্রণোদনার অর্থ সরকার প্রদান করে থাকে। সুতরাং এটি ব্যাংকের কোনো বাণিজ্যিক শর্তের উপর নির্ভরশীল নয়।
ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী বিশ্লেষণ
১. প্রণোদনার প্রকৃতি
ইসলামে যেকোনো লেনদেনের ক্ষেত্রে সুদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ। সুদ বলতে মূলত এমন কোনো অতিরিক্ত অর্থ বোঝানো হয়, যা বিনিময়মূলক চুক্তিতে চুক্তিকারী পক্ষদ্বয়ের কোনো একপক্ষ মূল চুক্তিতে শর্তের ভিত্তিতে প্রাপ্ত হয়। (হেদায়া ৩য় খন্ড, ৭৮)
সংজ্ঞাটির আরবি পাঠ :
الربا هو الفضل المستحق لأحد المتعاقدين في المعاوضة الخالي عن عوض شرط فيه
কিন্তু সরকারের দেওয়া এই প্রণোদনা ‘ইনআম’ বা ‘পুরস্কার’ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি কোনো শর্তসাপেক্ষে পক্ষদ্বয়ের পক্ষ থেকে নয়, বরং বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর উৎসাহ হিসেবে সরকারের (তৃতীয় পক্ষ) পক্ষ থেকে প্রদান করা হয়।
দলিল:
কোরআনে বলা হয়েছে :
أحل الله البيع وحرم الربا
আল্লাহ সুদকে হারাম করেছে আর বিক্রয়কে হালাল করেছে। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
এই প্রণোদনা কোনো রূপে সুদ হিসেবে বিবেচিত হয় না কারণ এটি সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনীতির উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে প্রদত্ত একটি সুবিধা।
২. প্রণোদনা গ্রহণের বৈধতা
সরকারি এই প্রণোদনার অর্থ মূলত বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য বাড়ানোর একটি প্রতীকী প্রতিফল। কোনো শর্ত ছাড়াই সরকার প্রবাসীদের জন্য এই সুবিধা দিচ্ছে। এটি হলো পুরস্কার যা সরকার বা সংস্থা প্রেরককে প্রদান করে সরকার-স্বীকৃত চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরকে উৎসাহিত করার জন্য। ইসলামে পুরস্কার গ্রহণ করা বৈধ।
ফিকহ বিশেষজ্ঞদের অভিমত
দারুল ইফতা, মিশর
দারুল ইফতা (ফতোয়া বিভাগ) মিশরের মতে, সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত প্রণোদনা যদি কোনো সুদের শর্ত ছাড়া বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণের জন্য পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়, তবে তা গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হালাল।
২. সৌদি আরবের ফতোয়া বোর্ড
সৌদি আরবের ফতোয়া বোর্ড উল্লেখ করেছে যে, এই প্রণোদনার অর্থ সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত একটি ন্যায্য পুরস্কার, যা শরিয়াহ অনুযায়ী বৈধ।
৩. বাংলাদেশে ইসলামিক স্কলারদের মতামত
বাংলাদেশের ইসলামি স্কলারদের মতে, রেমিট্যান্সের উপর সরকারের প্রণোদনা গ্রহণ বৈধ কারণ এটি সুদের আওতায় পড়ে না।
রেমিট্যান্সের উপর সরকারের দেওয়া ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী বৈধ এবং হালাল। এটি সুদের কোনো শর্তে আবদ্ধ নয় এবং এটি বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণকে উৎসাহিত করার একটি মাধ্যম। প্রবাসীদের এই প্রণোদনা গ্রহণ করতে কোনো দ্বিধা করার প্রয়োজন নেই।
মুফতি ইউসুফ সুলতান বলেছেন:
“Yes it will be halal. It is coming from a third party (Gov) as an encouragement to bring remittance in the country. It’s not considered an excess in a loan contract. The sender is sending money to the recipient, through a bank. Bank is the service provider. Gov is totally a third party. It’s a hadya or gift…”
“হ্যাঁ, এটি হালাল হবে। এটি তৃতীয় পক্ষ (সরকার) থেকে আসছে, যা দেশের মধ্যে রেমিট্যান্স আনতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রদান করা হচ্ছে। এটি ঋণ চুক্তিতে কোনো অতিরিক্ত অর্থ হিসেবে বিবেচিত নয়। প্রেরক ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে অর্থ পাঠাচ্ছেন। ব্যাংক এখানে সেবাদাতা হিসেবে কাজ করছে। সরকার সম্পূর্ণরূপে একটি তৃতীয় পক্ষ। এটি একটি উপহার বা হাদিয়া।”
পরিশেষে, ইসলামে প্রতিটি লেনদেনের ক্ষেত্রে সততা ও ন্যায্যতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রণোদনা সেই ন্যায্যতারই একটি উদাহরণ, যা দেশের অর্থনীতি ও প্রবাসী কল্যাণে ভূমিকা রাখে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post