গেলো বছরের ৩১ ডিসেম্বর সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ শেষ হতে না হতেই মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ প্রত্যেকটি প্রদেশে চলছে ধর পাকড়। তাদের ধরতে নানান ধরনের নামে চলছে পুলিশি অভিযান।
অভিবাসন বিভাগ বলছে, স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে বিদেশিরা অবৈধভাবে বসবাস ও ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এখন থেকে পুলিশের ফোকাস বিদেশিদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় থাকবে এবং এই বিদেশি নাগরিকদের অনুপ্রবেশ রোধে সমন্বিত অভিযান সময়ে সময়ে ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত হবে।
এতে কঠিন সময় পার করছেন দেশটিতে বসবাসরত বৈধ ও অবৈধ প্রবাসীরা। চলতি মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত অভিবাসন বিভাগের কয়েকটি অভিযানে অন্তত সাত-শ’রও বেশি অবৈধ প্রবাসীদের আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত আড়াই শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশিও রয়েছেন।
১০ জানুয়ারি রাজধানী কুয়ালালামপুরে পেটালিং স্ট্রিটে অভিযান চালিয়ে ৩৪ জন অবৈধ অভিবাসীকে আটক ইমিগ্রেশন বিভাগ। বিদেশি নাগরিকরা অবৈধ পণ্য বিক্রির একটি হটস্পট এলাকায় ইমিগ্রেশন বিভাগ ‘কেএল স্ট্রাইক ফোর্স’ নামের অভিযানের মাধ্যমে অভিবাসীদের আটক করা হয়।
কুয়ালালামপুর ইমিগ্রেশন পরিচালক ওয়ান মোহাম্মদ সৌপি ওয়ান ইউসুফ বলেছেন, এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অভিযান চালিয়ে ৭৭ জন বিদেশি নাগরিককে তল্লাশি করা হয়। এই সংখ্যার মধ্যে যাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই এমন ৩৪ জনকে আটক করা হয়েছে।
আটকদের মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশি, চারজন মিয়ানমারের নাগরিক, দুইজন পাকিস্তানি এবং মরিশাস ও নেপালের নাগরিক রয়েছেন। যাদের বয়স ২২ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে।
সৌপি ওয়ান বলেছেন, পাসের অপব্যবহার, তাদের কাছে বৈধ অস্থায়ী কাজের ভিজিট পাস এবং ওয়ার্ক পারমিট ছিল কিন্তু তারা তাদের নির্ধারিত স্থানে বা তাদের প্রকৃত নিয়োগকর্তাদের সাথে ছিল না।
ওয়ান মোহাম্মদ সৌপি আরও বলেন, যারা তাদের পাসের অপব্যবহার করেছেন তাদের বেশিরভাগই নির্মাণ পাস, পরিষ্কার ও ধোয়ার সেক্টর পাস এবং অন্যান্য অনুরূপ সেক্টর পারমিটধারী ছিলেন।
এই বিদেশি নাগরিকদের নিয়োগকারী প্রাঙ্গণগুলোতেও পরিদর্শন করা হয়েছিল এবং চারজন স্থানীয় ব্যবসা মালিককে জরিমানা করা হয়েছে।
অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিদেশিদের জন্য একটি পছন্দের গন্তব্য। কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝামাঝি এবং সেইসাথে ভালো পরিবহন সুবিধা, মালয়েশিয়াকে এই অঞ্চলে শ্রম গতিশীলতার প্রধান প্রবেশদ্বার করে তোলে।
দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মিলিত হয়ে, মালয়েশিয়া দ্রুত বর্ধনশীল খাতে যেমন নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, উৎপাদন এবং পরিষেবাগুলোতে বিভিন্ন কাজের সুযোগ প্রদান করে।
এই কারণগুলো মালয়েশিয়াকে বিদেশি কর্মীদের জন্য প্রধান আকর্ষণ করে তোলে যারা তাদের মূল দেশের তুলনায় উন্নত জীবন এবং আরও কাজের সুযোগ খুঁজতে আসে।
বিজ্ঞাপএই বিদেশিদের উপস্থিতি চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে যা উপেক্ষা করা যায় না। যদিও মালয়েশিয়া সমালোচনামূলক খাতে বিদেশি শ্রম অবদানের সুবিধা ভোগ করে, বিদেশি অভিবাসীদের আগমন, বিশেষ করে যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই, বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সমস্যা তৈরি করেছে।
এর মধ্যে রয়েছে অভিবাসন আইন মেনে না চলা, শ্রমিকদের শোষণের পাশাপাশি বিদেশি ও স্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে সামাজিক উত্তেজনা।
মালয়েশিয়ায় বিদেশি অভিবাসীদের ইস্যুতে গভীর মনোযোগ এবং একটি সামগ্রিক সমাধান প্রয়োজন যেন দেশের অর্থনীতির চাহিদা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের কল্যাণের মধ্যে ভারসাম্য আরও কার্যকরভাবে অর্জন করা যায়।
বিদেশি শ্রমের প্রয়োজন:
মালয়েশিয়ায় বিদেশি অভিবাসীদের উপস্থিতির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু খাতে শ্রমের প্রয়োজন, বিশেষ করে যেগুলো স্থানীয় শ্রমিকদের অনাগ্রহী। নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, উৎপাদন এবং পরিষেবা খাতগুলো বিদেশি শ্রমের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর মধ্যে একটি।
মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের তথ্যের ভিত্তিতে, মালয়েশিয়ায় ১.৭ মিলিয়নেরও বেশি বৈধ বিদেশি কর্মী রয়েছে। অনুমান করা হয়, ২ থেকে ৪ মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসী রয়েছে যারা এখনও এই দেশে কাজ করছে।
আইডিপিরা প্রায়ই আইনি প্রক্রিয়া না করেই দেশে প্রবেশ করে, যা তাদের মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট এবং অন্যান্য ঝুঁকির দ্বারা শোষণের শিকার করে তোলে।
তাদের বেশিরভাগই ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, নেপাল এবং ফিলিপাইন থেকে এসেছেন ভালো চাকরির সুযোগ খুঁজতে।
অবৈধ অভিবাসীদের আগমন এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জ:
মালয়েশিয়ায় অবৈধ অভিবাসীদের উপস্থিতি নিরাপত্তা এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। অবৈধ অভিবাসীরা প্রায়ই অবৈধ পথ দিয়ে দেশে প্রবেশ করে, কর্তৃপক্ষের জন্য তাদের ট্র্যাক করা কঠিন করে তোলে।
কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা:
বিদেশি শ্রমের ওপর নির্ভরশীলতা স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলে। বিদেশি শ্রমিকদের উপস্থিতি, বিশেষ করে স্বল্পদক্ষ সেক্টরে, চাকরির বাজারে চাপ সৃষ্টি করে।
ব্যাংক নেগারা মালয়েশিয়ার ডেটা দেখায় যে নির্দিষ্ট কিছু খাতে বিদেশি কর্মীদের উপস্থিতির কারণে স্থানীয় মজুরির হার কমে যায়, বিশেষ করে যেক্ষেত্রে নির্মাণ এবং গাছ লাগানোর মতো শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়।
চাকরির প্রতিযোগিতার বিষয়ে উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও, এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে যে বিদেশি কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নিয়োগকর্তারা প্রায়ই স্থানীয় কর্মীদের এমন কাজগুলো সম্পাদন করতে অসুবিধার সম্মুখীন হন যা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় এবং শারীরিক শক্তির প্রয়োজন হয়। এই সেক্টরে শূন্যপদ পূরণের জন্য নিয়োগকর্তারা বিদেশি কর্মীদের পছন্দ করে।
বিদেশি অভিবাসীদের সমস্যা মোকাবিলায় সরকারি ব্যবস্থা:
মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগ এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোর দ্বারা প্রয়োগকারী অভিযানগুলো জোরদার করা অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক, দেশের আইন না মেনে অবৈধ অভিবাসীদের আটক ও নির্বাসনের জন্য বিভিন্ন বৃহৎ পরিসরে অভিযান চালানো হয়েছে। এই অভিযানের মধ্যে অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের প্রধান অবস্থান হিসাবে পরিচিত নির্মাণ সাইট, কারখানা এবং কৃষি এলাকা।
ভবিষ্যতের জন্য আরও ভাল ব্যবস্থাপনা:
বিদেশি কর্মীদের ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য, মালয়েশিয়া সরকার আরও ব্যাপক ই-ওয়ার্ক সিস্টেম চালু করার পরিকল্পনা করছে। এই ব্যবস্থাটি নিয়োগকর্তাদের তাদের বিদেশি কর্মীদের আরও স্বচ্ছভাবে নিবন্ধন করার অনুমতি দেবে, পাশাপাশি বিদেশি কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়াটি সঠিক চ্যানেলের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়েছে তা নিশ্চিত করবে।
এই পদক্ষেপটি শোষণের চর্চা কমানোর পাশাপাশি মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়াই করবে যা বিদ্যমান ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নেয় বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়াও, মানবপাচার এবং বিদেশি শ্রমিকদের শোষণের সমস্যা মোকাবিলায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। মালয়েশিয়া এই সমস্যা মোকাবিলায় একা কাজ করতে পারে না, কারণ চোরাচালান সিন্ডিকেট প্রায়ই বিভিন্ন দেশে কাজ করে।
একটি নিরাপদ এবং আরও সুশৃঙ্খল অভিবাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য অভিবাসীদের উদ্ভব দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
মালয়েশিয়ায় বিদেশি অভিবাসীদের ইস্যুটি একটি জটিল সমস্যা এবং বিভিন্ন কোণ থেকে একটি ব্যাপক পদ্ধতির প্রয়োজন।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশি কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, অবৈধ অভিবাসীদের আগমন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ।অর্থনৈতিক চাহিদা এবং স্থানীয় জনগণের কল্যাণের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পেতে সরকার, নিয়োগকর্তা এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করতে হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post