১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিটা অর্জনের পেছনে প্রবাসীদের অবদান অনন্য।
নয় মাসের সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন তেমনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। পাশাপাশি অর্থ ও রসদ সংগ্রহেও তাদের ভূমিকা অনেক। একইভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই বাংলাদেশ গড়ার পেছনেও প্রবাসীরা দারুণ ভূমিকা রাখছেন, বিশেষত প্রবাসী আয় পাঠিয়ে।
শুধু মুক্তিযুদ্ধ কিংবা জুলাই-আগস্টের আন্দোলন নয়, এই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোটি প্রবাসী ভূমিকা রাখছেন। বিশ্বমন্দা হোক কিংবা করোনা মহামারি! হোক ডলার কিংবা রিজার্ভ সংকট সবসময় ভরসা এই প্রবাসীরা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও তারা পাঠিয়েছেন প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার। কয়েকমাস ধরেও প্রবাসী আয় ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্বব্যাংক ও নোমাডের প্রতিবেদন বলছে, প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সপ্তম।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন যার ৭৫ শতাংশই আছেন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান ও বাহরাইনে। এছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, জর্ডান, লেবানন, ইতালি এবং দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কম বেশি আছেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা।
মূলত নির্মাণ শ্রমিক, প্লান্টেশন, কৃষি, সার্ভিস বা উৎপাদন খাতে অদক্ষ কর্মী হিসেবে কাজ করতে যান বাংলাদেশিরা। তবে একটা বিষয় ভীষণ ইতিবাচক। বাংলাদেশিরা খুব দ্রুত কাজ ও ভাষা শিখে যান। এরপর কঠোর পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠান।
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কেউ জানতে চাইলে আমি তিনটি অক্ষর বলি। ই (E), এফ (F) এবং জি (G)। ই (E) মানে এক্সপাট্রিয়েট ওয়ার্কার (Expatriate Worker) বা প্রবাসী শ্রমিক। এফ (F) মানে ফার্মারস (Farmers) বা কৃষক। আর জি (G) মানে গার্মেন্টস ওয়ার্কার (Garment Worker) বা পোশাকশ্রমিক। যে যত বড় কথায় বলুক বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত আসলে এই তিন খাতে দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে প্রবাসীদের অবদান অনন্য।
বিশ্বমন্দা হোক কিংবা করোনা মহামারি! হোক ডলার কিংবা রিজার্ভ সংকট সবসময় ভরসা এই প্রবাসীরা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও তারা পাঠিয়েছেন প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ এখন আর বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল কোনো দেশ নয় তার একটা বড় কারণ প্রবাসী আয়। শুনলে অবাক হতে পারেন, সারা বিশ্ব মিলে বাংলাদেশকে এখন যে পরিমাণ ঋণ বা অনুদান দিচ্ছে বা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) যে অর্থ আসছে তার চেয়ে ছয় থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
২০০৭-২০০৮-২০০৯ সালে সারা বিশ্বব্যাপী যখন অর্থনৈতিক মন্দা তখন প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের কারণে বাংলাদেশকে কোনো সংকটে পড়তে হয়নি। আবার করোনা মহামারির মধ্যেও রেকর্ড পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। জুলাই-আগস্টে প্রতিবাদ করে প্রবাসীরা প্রবাসী আয় পাঠানো কমিয়ে দিলেও কয়েকমাস ধরে প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠাচ্ছেন।
অন্যদিকে অনাবাসী বাংলাদেশিরা আছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মান, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর নানা দেশে। তারা দেশে যেমন প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন তেমনি বিদেশেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন তাদের কাজ দিয়ে। এই যে প্রবাসী ও অনাবাসী বাংলাদেশিরা দেশের জন্য সবসময় অবদান রাখছেন তাদের অবদানের কতটা স্বীকৃতি দিতে পেরেছে বাংলাদেশ?
প্রবাসীদের অবদানের স্বীকৃতি দিতেই ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর মন্ত্রী পরিষদের সভায় প্রতি বছরের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রবাসী দিবস পালনের এই সিদ্ধান্ত হয়। ২০২৪ সালে ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ও প্রবাসী দিবসের অনুষ্ঠান জাতীয়ভাবে একসঙ্গে হয়েছে।
বাংলাদেশের কেন প্রবাসীদের কথা বারবার স্মরণ করা উচিত? একটু পেছনে ফিরলে দেখা যাবে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন বিজয় লাভ করে তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত এই বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্রতম দেশ।
একদিকে প্রায় শূন্য রিজার্ভ আরেকদিকে ডলারের তীব্র সংকট, ভাঙা সব রাস্তাঘাট। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর বাংলাদেশের ইতিবাচক অর্থনীতির পেছনে বিশাল অবদান রেখেছে প্রবাসীরা। মূলত এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বিদেশ থেকে এই প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন।
তবে যারা দেশকে এত দিচ্ছেন সেই প্রবাসীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই এর শুরু। এরপর মধ্যসত্ত্বভোগী ও দালালদের দৌরাত্ম্য, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্র—সবক্ষেত্রে সীমাহীন যন্ত্রণা।
দেশের আকাশ পাড়ি দিলেই শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত-কী। দেশে ফিরলেও সেই একই কষ্ট! সবচেয়ে বড় কথা, প্রবাসীরা বিদেশে থাকেন বলে তাদের ভোটাধিকার নেই। ফলে তাদের কথা যেন কেউ শোনে না। অথচ ভারত কিংবা ফিলিপাইন তাদের প্রবাসীদের জন্য অনেক উদ্যোগ নিচ্ছে।
অনাবাসী কিংবা প্রবাসী এবং প্রবাসী আয় সবদিক থেকেই গোটা পৃথিবীর শীর্ষ দেশ ভারত। সেই ভারত তাদের প্রবাসী নাগরিকদের অবদানের স্মরণে প্রতি বছরের ৯ জানুয়ারি প্রবাসী ভারতীয় দিবস পালন করে থাকে। ৯ জানুয়ারি বেছে নেওয়ার কারণ ১৯১৫ সালের এইদিনে মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে এসেছিলেন।
২০০৩ সালে ভারত সরকারের অনাবাসী ভারতীয় দপ্তর, কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই) ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়ন দপ্তর দিনটি পালন শুরু করে। এখন এটি ভারতের রাষ্ট্রীয় দিবস। বিদেশে ভারতের প্রতিটা দূতাবাসে দিবসটি পালন করা হয়।
পাশাপাশি ভারতের কোনো একটা বড় শহরে প্রবাসী ভারতীয় দিবসের কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান ও সম্মেলনের আয়োজন করা হয় যেখানে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছেন এমন গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের স্বীকৃতি জানিয়ে প্রবাসী ভারতীয়দের সম্মান জানানো হয়। এটি অনাবাসী ভারতীয় এবং বিদেশি নাগরিকদের জন্য সর্বোচ্চ ভারতীয় পুরস্কার।
প্রবাসী ভারতীয় দিবসের এই সম্মেলন এখন ভারতের একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প যেটি বিদেশে বসবাসকারীদের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ গড়ে তুলতে দারুণ ভূমিকা রাখছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকা অনাবাসী ভারতীয়রা এসব অনুষ্ঠানে আসার জন্য নাম নিবন্ধন করেন। এখানে প্রবাসীরা ভারতের বিভিন্ন নীতির বিষয়ে তাদের মতামত দেন। ভারতের নানা প্রকল্প ও উদ্যোগেও যুক্ত হন। এছাড়া ওই সম্মেলনে স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রাখা প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী থাকে।
একইভাবে ফিলিপাইন বিমানবন্দরে প্রবাসীদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি দূতাবাসগুলোয় বিশেষ সেবা দিয়ে থাকে। প্রবাসীরা কোনো অভিযোগ করা মাত্রই সেটি প্রতিকারে ব্যস্ত হয়ে ওঠে ফিলিপাইন সরকার। অথচ বাংলাদেশ প্রবাসীদের যথাযথ সম্মান দিতে পারে না। অথচ প্রবাসী ও অনাবাসী বাংলাদেশিদের জন্য রাষ্ট্রীয় নানা উদ্যোগ থাকা উচিত। বিশেষত কী করে তারা খুব সহজে দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন, কীভাবে তাদের মেধা ও দক্ষতা কাজে লাগানো যায়, সারা বছর জুড়ে কীভাবে প্রবাসীদের দেশের সঙ্গে যুক্ত করা যায় এগুলো ভাবতে হবে।
এছাড়া দেশে থাকা প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যদের জন্যও সরকার নানা উদ্যোগ নিতে পারে। এক্ষেত্রে তার সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, লেখাপড়ায় বৃত্তি, চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিশেষ সুবিধাসহ আরও অনেককিছু ভাবা যেতে পারে।
দেশের আকাশ পাড়ি দিলেই শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত-কী।
স্বীকার করতেই হবে সরকার এসব ব্যাপারে আগের চেয়ে আন্তরিক। তবে যত কথা হয় সেই তুলনায় কাজ হয় না। বিশেষ করে কোটি প্রবাসীদের ভোটাধিকার খুব জরুরি। কয়েক বছর ধরে বিষয়টা আলোচনাতেই আটকে আছে।
আসলে অভিবাসন একটা বাস্তবতা। কিন্তু একজন মানুষ পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না তার বুকের মধ্যে থাকে জন্মভূমির প্রতি টান, পরিবার-স্বজনদের প্রতি টান। শেকড়ের টানের মতো সেই জন্মভূমি তাকে টানে, সেখানে তিনি আসতে চান, কিছু করতে চান! কাজেই তাকে আনতে হবে, কাজে লাগাতে হবে, তার কথা শুনতে হবে। তাদের সম্মান ও নানা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দিতে হবে। এগুলো করতে পারলেই জাতীয় প্রবাসী দিবস সার্থক হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, কোটিরও বেশি প্রবাসী শুধু যে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন তা নয়, অনেক দূর থেকেও বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখেছেন লাল-সবুজের জন্য ভালোবাসা। দেশের যেকোনো সংকটে তারাই আমাদের ভরসা।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post