প্রবাসীর টাকায় শকুনের নজর: ইতালি প্রবাসী সারাফাত ইসলাম ডলার, ১২ বছর ধরে থাকেন মিলান শহরে। মিলানে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকায় দেশ থেকে অনেককে নিয়েছেন ইতালি। দিয়েছেন কাজের সুযোগ। নিজ জেলা মাদারীপুরের কয়েকশ মানুষকে ইতালি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই পরোপকারী মানুষটির প্রতিও যেন ঈর্ষার শেষ নেই কিছু অসাধু মানুষের। যেভাবেই হোক তার থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে হবে, এমনই যেন প্রতিজ্ঞা। এরই অংশ হিসেবে শেষমেষ জুড়ে দিলেন মিথ্যা মামলা।
কখনো কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকলেও ৫ আগস্টের এক হত্যামামলায় আসামি করা হয় সারাফাত ইসলাম ডলার ও তার অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক বাবাকে। অথচ মামলার বাদী চেনেনই না তাদের। মামলার নথিতেও রয়েছে ব্যাপক গড়মিল।
মামলার নথিতে রাজা জমাদ্দারের বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ৫২ বছর। অথচ তার জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী বয়স ৬৮ বছর। একই মামলায় তার ছোট ছেলে ইতালি প্রবাসী সারাফাত ইসলাম ডলারকে দেখানো হয়েছে ৩৮ বছর। বয়সের পার্থক্য ১৪ বছর, যা বাস্তবতা বিবর্জিত। এমন অসঙ্গতি অধিকাংশ আসামির ক্ষেত্রেই। এসব বিষয়ে মামলার বাদি জানেন না কিছুই।
স্থানীয়দের দাবি, ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণেই এ মামলা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার সিএমএম আদালতে মনিরুজ্জামান মনির নামে এক যুবক নিহতের ঘটনায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। মামলায় ২৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২১ জন মাদারীপুরের বাসিন্দা।
অন্য আসামিরা হচ্ছেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ। এই পাঁচজনের ঠিকানা ঢাকার হলেও ২১ জনের কেউই ঢাকার বাসিন্দা নন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকার রাজনৈতিক বিরোধ ও ব্যক্তিগত শত্রুতাকে কেন্দ্র করে মাদারীপুরের ২১ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে, আসামির নাম বাদ দিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম তুষার ভূঁইয়া। তিনি নীরিহ এই হত্যাকাণ্ডকে পুঁজি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। একাধিক আসামির কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিহত মনিরুজ্জামান মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার শাখারপাড় এলাকার নুরুল ইসলাম মোল্লার ছেলে। মনিরুজ্জামান মনিরকে মামলার এজাহারে রিকশাচালক উল্লেখ করা হয়। অথচ এই প্রতিবেদক খোঁজ নিয়ে জানতে পারে নিহত মনিরুজ্জামান একটি জুতা কোম্পানিতে কাজ করতেন। ওই কোম্পানির মালিক আসাদুজ্জামান অন্তু বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মামলার নথিতে আরো অসঙ্গতি পাওয়া যায় তার বাহন নিয়ে। নথিতে উল্লেখ করা হয়, মনিরুজ্জামান রিকশা চালানোর সময় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু নিহতের সঙ্গে থাকা তার বন্ধু আলম কাজী ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা ৫ আগস্ট মোটরসাইকেল নিয়ে গণভবনে যাই। পতাকা হাতে নিয়ে ছবি তুলি। কত স্মৃতি আমাদের। ফেরার পথে ফুলবাড়িয়ায় যখন পুলিশের সঙ্গে লোকজনের সংঘর্ষ হচ্ছিল, আমরা তখন মাঝখানে পড়ে যাই। চারদিকে গুলির আওয়াজ। কিছু লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের ওপর প্রথম হামলা চালায়। কিছুক্ষণ পরে দুজন দুদিকে সরে পড়ি। এরপর কিছু লোক আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে শুনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মনির (মনিরুজ্জামান) মারা গেছে। সেদিনের কথা এখনো চোখে ভাসে।’
তাদের বাহনকৃত মোটরসাইকেলটিও ছিল জুতা কোম্পানির মালিক অন্তুর। এত অসঙ্গতি ও প্রবাসীকে আসামি করার বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী নিলুফার ইয়াছমিন কথা বলতে রাজি হননি। তবে তিনি ‘আপাতত মামলার বিষয় কিছু বলতে চাই না’ বলে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদসহ মোট ২৬ জনের নাম আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে অজ্ঞাত হিসেবে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ৫ আসামির বর্তমান ঠিকানা ঢাকা বলে উল্লেখ করা হয়। নাম উল্লেখকৃত বাকি আসামিদের বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। মামলায়ও সবার ঠিকানা মাদারীপুর বলে উল্লেখ করা হয়।
এজাহারে বলা হয়, ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ভণ্ডুল করার জন্য পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সদস্যরা ও ছয় থেকে ২৭ নম্বর আসামিরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি করতে করতে পাড়া-মহল্লায় ঢুকে পড়ে এবং র্যাব হেলিকপ্টার থেকে মানুষের ওপর গুলি করে। এ মামলার ভিকটিম (মনিরুজ্জামান) তার রিকশা নিয়ে জীবিকার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভিকটিমের বুকে গুলি করা হয়। পরে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা ভিকটিমকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে ৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনি মারা যান। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মামলা করার বেশ কয়েকদিন আগে নিহত মনিরুজ্জামান মনিরের বাবা নুরুল ইসলাম মোল্লা গণমাধ্যমে জানান, ৫ আগস্ট সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয় মনিরুজ্জামান। সঙ্গে তার বন্ধু আলম ছিল। তারাও অন্যদের দেখাদেখি গণভবনে যায়। দুজনই লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বিজয় উল্লাস করে সন্ধ্যার আগে গণভবন থেকে বের হয়ে আসে। পরে তারা পুলিশ সদর দফতর সংলগ্ন ফুলবাড়িয়া এলাকায় গিয়ে একটি মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষ করার পর বের হয়ে দেখে তাদের মোটরসাইকেলটি দুর্বৃত্তরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যেই পুলিশ সদর দফতরের সামনে শুরু হয় গোলাগুলি। মনিরুজ্জামান ও আলম জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটি শুরু করে। এ সময় মনিরুজ্জামান গুলিবিদ্ধ হয় ও আলম মারধরের শিকার হন। পরে গুরুতর অবস্থায় দুজনকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ওইদিন রাতেই মনিরুজ্জামান ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, ‘মামলার তদন্ত বিশ্লেষণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। ঘটনার সময় যদি কেউ দেশের বাইরে থাকে তাও তদন্তে উঠে আসবে। নির্দোষ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’
জানা গেছে, আসামিদের প্রথম পাঁচজন ছাড়া সবাই মাদারীপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। এলাকায় জমিজমা ও ব্যবসায়িক বৈরিতা ও ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে তাদের আসামি করা হয়েছে। মামলার ১০ নম্বর আসামি মাদারীপুরের চরমুগরিয়া এলাকার বাসিন্দা সারাফাত ইসলাম ডলার প্রবাসী। তিনি ১২ বছর ধরে ইতালির মিলান শহরে আছেন। তার বাবা মামলার ১২ নম্বর আসামি রাজা জমাদ্দার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী।
স্থানীয় বাসিন্দা মাসুদ সরদার বলেন, সারাফাত ইসলাম ডলার ১২ বছর ধরে ইতালিতে থাকেন। তার বাবা অসুস্থ। ঘর থেকে বের হতে পারেন না। তাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আসামি করা হয়েছে।
মাদারীপুর জেলা কৃষকদলের সদস্য সচিব অহিদুজ্জামান খান বলেন, মাদারীপুর সদর উপজেলার সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম তুষার ভূঁইয়া কুপরামর্শ দিয়ে এই মিথ্যা মামলা করিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তুষার ভূঁইয়া মূলত আওয়ামী লীগের লোক। তার সঙ্গে যাদের দ্বন্দ্ব তাদের হয়রানি করার জন্য এ মামলা করিয়েছেন। মামলার আসামি সারাফাত ইসলাম ডলার কখনো কোনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ছাত্র আন্দোলনে নিহতের ঘটনা পুঁজি করে এমন ষড়যন্ত্র দুঃখজনক।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুজ্জামান বলেন, ঘটনাস্থল ঢাকা। মামলাও ঢাকায় হয়েছে। বিষয়টি আমাদের জেলা পুলিশের নয়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post