নাটোরের সিংড়ার বাসিন্দা মো. সাইফুল্লাহ (২০)। কাজের জন্য গত ৩১ মে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু দালাল ও এজেন্সির ভুলে শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। তাই একবুক হতাশা নিয়ে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শূন্যহাতে গ্রামে ফিরেছেন।
ঋণ করে জোগাড় করা ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা এখন দালালের থেকে কীভাবে উদ্ধার করবেন সেই চিন্তায় আছেন। কারণ পাওনা দারদের টাকা পরিশোধের চাপ নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।
ভুক্তভোগী সাইফুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্বপ্ন ছিল মালয়েশিয়া গিয়ে বাড়িতে টাকা পাঠানোর। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। আমার জন্য পুরো পরিবারের ঈদ আনন্দ মলিন হয়েছে। কারণ এ বছর ঈদে কোরবানি হবে না। দালালরা আমাদের ঈদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। তবুও বাবা-মা সঙ্গে থাকায় কিছুটা স্বস্তিতে আছি।’
তার মতো প্রায় কয়েক হাজার মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুর ঈদ কাটবে হতাশা আর অনিশ্চয়তায়। কারণ দেশটিতে যেতে না পারা কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। যাদের প্রত্যেকেই দালালের কাছে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা দিয়েছেন। কেউ জমি বন্ধক রেখে, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এই টাকা দিয়েছেন। ফলে মালয়েশিয়া যেতে না পারায় তারা টাকা উদ্ধারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
মালয়েশিয়া যেতে না পারা একাধিক ভুক্তভোগী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দালালদের জন্য আজ আমরা নিঃস্ব। ভাগ্য বদলের পরিবর্তে এখন টাকার জন্য দালালের কাছে ধরনা দিতে হচ্ছে। কবে টাকা পাবো তার নিশ্চয়তা নেই। তাই এবারের ঈদ আগের মতো হবে না। ঈদের আনন্দ মলিন হয়ে গেছে।’
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২১ মে পর্যন্ত গত আড়াই বছরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৪ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়। ২১ মের পর আর অনুমোদন দেওয়ার কথা না থাকলেও মন্ত্রণালয় আরও ১ হাজার ১১২ জন কর্মীকে দেশটিতে যাওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। সব মিলে ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে গত ৩১মে পর্যন্ত দেশটিতে যেতে পেরেছেন ৪ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ জন। আর এজেন্সির প্রতারণাসহ টিকিট জটিলতায় মালয়েশিয়া যেতে পারেননি অনুমোদন পাওয়া ৩১ হাজার ৭০১ জন কর্মী।
জনশক্তি রপ্তানির নিরিখে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। গত বছর সেখানে সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক গিয়েছিল, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৪৪ হাজারের বেশি শ্রমিক গেছেন। দেশটিতে বাংলাদেশের রমরমা শ্রমবাজার হলেও দুর্নীতির কারণে ২০১৮ সালের পর ফের বন্ধ হল। মালয়েশিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত ৩১মে পর থেকে বাংলাদেশি কোনো কর্মীকে দেশটিতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। এ শ্রমবাজার বন্ধের জন্য দুই দেশের সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ায় হাইকমিশনার হাসনা মোহাম্মদ হাসিম।
তিনি গত ২৯ মে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সিন্ডিকেট বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটা ভাঙতে আমরা চেষ্টা করছি। এটা এখনো আমাদের (উভয় সরকারের) নিয়ন্ত্রণে নেই।’
ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ৩১ মে পর বিদেশি কর্মীদের প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
জানা গেছে, দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করেছিল। তখন ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির গড়ে তোলা চক্রের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হন লাখো শ্রমিক। চাকরির নিশ্চয়তা, আবাসন ও খাওয়ার ব্যবস্থার কথা বলে তারা হাতিয়ে নেয় কয়েক কোটি টাকা। বন্ধ হওয়া শ্রমবাজার আবার চালু করতে সময় লেগেছিল তিন বছর। ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নতুন সমঝোতা চুক্তির আওতায় ফের চালু হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ২০২২ সালের আগস্টে ফের বাংলাদেশি কর্মীদের সেখানে যাওয়া শুরু হয়।
নতুন সমঝোতার পর ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট ভেঙে দায়িত্ব দেওয়া হয় ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সিকে। পরে শ্রমিক পাঠানোর অনুমতি পায় ১০০ এজেন্সি। তবু অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। নতুন সমঝোতার পর সে দেশে গিয়ে লাখো বাংলাদেশি কর্মী প্রতারিত হয়েছেন। মাসের পর মাস কাজ না পেয়ে এখনো বন্দিজীবন পার করছেন অনেকেই। এ সিন্ডিকেটের ফাঁদেই দুই বছর পাঁচ মাসের মাথাই বন্ধ হলো দেশটির শ্রমবাজার।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post