দেশের জনশক্তি খাতের ওপর পড়েছে জালিয়াত চক্রের থাবা। একের পর এক ‘বিএমইটি স্মার্ট কার্ড’ জালিয়াতির ঘটনায় উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা। এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। বিদেশে গিয়ে কাজ না পাওয়াসহ আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবগামী অন্তত কয়েক হাজার কর্মী এই জালিয়াত চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও এভাবে অবৈধ উপায়ে স্মার্ট কার্ড ইস্যু করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনও তথ্য কারও কাছে নেই।
বৈধভাবে বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার জন্য জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) নিবন্ধিত হতে হয়। এই নিবন্ধন জেলা অফিস কিংবা অনলাইনে ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপের মাধ্যমে করা যায়। নিবন্ধিত হওয়ার পর কর্মীর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে ক্লিয়ারেন্স হিসেবে তাকে ‘স্মার্ট কার্ড’ দেওয়া হয়। এই কার্ড সংগ্রহ করে বিদেশে যেতে হয় কর্মীদের।
২০২২ সালে বিএমইটি স্মার্ট কার্ডের জালিয়াতি তদন্ত করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, জালিয়াতি করে সংযুক্ত আরব আমিরাতগামী কর্মীদের ভুয়া বহির্গমন ছাড়পত্র (স্মার্ট কার্ড) দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ অনুমতি ছাড়াই রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালরা ভুয়া স্মার্ট কার্ডে কর্মীদের বিদেশ পাঠিয়েছে। বিএমইটির ৯ কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং ছয় রিক্রুটিং এজেন্সি জালিয়াতিতে জড়িত বলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তদন্ত হয়েছে সীমিত পরিসরে, আমিরাতে লোক পাঠানো মাত্র আটটি এজেন্সির বিরুদ্ধে। অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও স্মার্ট কার্ডে একই ধরনের জালিয়াতি ঘটেছে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির তদন্তে পাওয়া গেছে, আরব আমিরাতে ২ হাজার ৯৬০ জন কর্মীর নিয়োগ অনুমতির বিপরীতে ৬ হাজার ৯৩৮টি স্মার্ট কার্ড দিয়েছে বিএমইটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ হাজার ৯৭৮টি স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে ‘ন্যক্কারজনকভাবে’ ও ‘অকল্পনীয় জাল-জালিয়াতি করে’।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অন্যান্য নিয়োগ অনুমতির ক্ষেত্রে আরও কত সংখ্যক স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে এর হিসাব নেই। তবে সংখ্যাটি অনেক বড়। ২০২১ সালে ২৯ হাজার ২০২ জন এবং ২০২২ সালে আগস্ট পর্যন্ত ৭০ হাজার ২০৩ বাংলাদেশি কর্মী আমিরাতে গেছেন। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও অবৈধভাবে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে কিনা, তার তদন্ত হয়নি।
সেসময় তদন্ত কমিটির কাছে তৎকালীন মহাপরিচালক মো. শহিদুল আলম জবানবন্দিতে বলেছিলেন, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর সিস্টেমে ইনপুট দিতে নথি অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে সিস্টেমে এন্ট্রি করা হয়। সেই অনুযায়ী রিক্রুটিং এজেন্সির আবেদনে বহির্গমন ছাড়পত্রের কার্ড প্রিন্ট হয়। মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ অনুমতির বাইরে বহির্গমন কার্ড দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে যদি তা হয়ে থাকে তাহলে কে, কীভাবে দিয়েছে জানা নেই।
তবে বিএমইটির ৯ কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং ৬ রিক্রুটিং এজেন্সি জালিয়াতিতে জড়িত বলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অবশ্য পরে বিএমইটি মহাপরিচালক শহিদুল আলম অপর এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জানিয়েছিলেন, জালিয়াতি যেটা হয়েছে সেটা বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স নয়, বাইরের একটি চক্র বিএমইটি কার্ডের অনুরূপ কার্ড বানিয়েছে। এর সঙ্গে বিএমইটি’র কর্মকর্তা জড়িত নয়।
এর আগে গত আগস্টে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে বিএমইটি বরাবর একটি চিঠি দিয়ে বলা হয় বিএমইটি সার্ভার থেকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তথ্য মুছে দেওয়ার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আল মামুন ওভারসিজ এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত মামুন নামক এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে। এরপর মামলা দায়ের করা হয়।
গত বছর মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর একটি ঘটনা চিহ্নিত হওয়ার পর তদন্ত করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। মালয়েশিয়ান কোম্পানি এক্সিয়ানার্জি (এম) এসডিএন বিএইচডিতে ১৫০ কর্মী পাঠাতে রিক্রুটিং এজেন্সি আল মামুন ওভারসিজ জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। তবে এজেন্সিটি মালয়েশিয়ান সরকারের তালিকাভুক্ত নয়। এ কারণে আল হেরা ওভারসিজের নামে এসব কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র ইস্যু করা হয়। আল মামুন ওভারসিজ নির্বাচিত কর্মীদের পাসপোর্ট না দিয়েই আল হেরা ওভারসিজকে বিএমইটি ছাড়পত্রের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া শুরুর অনুরোধ করে। আল হেরা ওভারসিজ সেই প্রক্রিয়া শুরু করলেও ভিন্ন পথে হাঁটে আল মামুন ওভারসিজ। তারা বিএমইটির অসাধু কর্মীদের যোগসাজশে গত বছরের জুনের শেষ দিকে ঈদের ছুটির সময় অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠান আল-খামিজ ইন্টারন্যাশনালের (আরএল ৬৮০) নামে বহির্গমন ছাড়পত্র সংগ্রহ করে ১২০ কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দেয়। অথচ আল-খামিজ ইন্টারন্যাশনালের কেউ এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না।
পরে বিষয়টি জানতে পেরে আল-খামিজ ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. ফরিদ আহমদ ৯ জুলাই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আল মামুন ওভারসিজের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেন। এরপর তদন্ত করে বিএমইটি। এই ঘটনায় রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করে বিএমইটি।
তখন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ জানিয়েছিলেন, দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
এই বছরের জানুয়ারিতে সৌদি আরবে যেতে ইচ্ছুক এক কর্মীর আবেদনের নথি বিএমইটির একজন পরিচালকের সামনে আসে। নথি পর্যালোচনা করে ওই কর্মকর্তা একটি স্মার্ট কার্ডও দেখতে পান। কিন্তু দাখিল করা স্মার্ট কার্ডসহ নথি বা অ্যাপ—কোনোটিই তিনি অনুমোদন করেননি। কার্ডের বিষয়ে তার সন্দেহ হলে তিনি আরও কিছু নথিতে নজর রাখা শুরু করেন। কিছু দিনের মধ্যে একের পর এক বেরিয়ে আসে জালিয়াত চক্রের তৈরি করা ২৪টি স্মার্ট কার্ডের তথ্য। এরপর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
বিএমইটি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেগুলোর মধ্যে রিক্রুটিং এজেন্সি বাংলাদেশ এক্সপোর্ট করপোরেশনের (আরএল-৮০৩) নামে গত ২ জানুয়ারি ৭টি এবং ৩ জানুয়ারি ১টি স্মার্ট কার্ড নেওয়া হয়েছে। আর সাদ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের (আরএল-১০৬৮) নামে গত ১ জানুয়ারি ৭টি ও ৩ জানুয়ারি ৫টি স্মার্ট কার্ড নেওয়া হয়েছে।
বিএমইটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই সময় বিএমইটির নিয়মিত অতিরিক্ত মহাপরিচালক (কর্মসংস্থান) ছুটিতে ছিলেন। তার দায়িত্বে ছিলেন এডিজি (প্রশিক্ষণ) আশরাফুল ইসলাম। তিনি তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, কোনও কর্মীর বাতিল আবেদন যাচাই করে চূড়ান্ত করেননি। ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপের সিস্টেম হ্যাক হওয়ার নজির আছে বলেও দাবি করেন আশরাফুল ইসলাম।
বিএমইটির ডিজিটাল সার্ভিস পার্টনার হিসেবে অনলাইনে সেবা দিয়ে আসছে ‘আমি প্রবাসী’ লিমিটেড নামে একটি অ্যাপ। এই অ্যাপের সিইও নামির আহমেদ জানান, বিদেশগামীদের কোনও তথ্য প্রমাণ করা বা বাতিল করার ক্ষমতা আমাদের নাই, এই ক্ষমতা বিএমইটির হাতেই ন্যস্ত।
‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, সিস্টেম ব্যবহারকারী ছাড়া তাদের কোনও কর্মকর্তার বা বাইরে থেকে অন্য কারও এ ধরনের কাজ করার সুযোগ নেই।
তাই জালিয়াতি বন্ধে সার্ভার সরিয়ে নেওয়াকেই সমাধান হিসেবে দেখছে বিএমইটি। তাই বর্তমান সার্ভার বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে (বিসিসি) সরিয়ে নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএমইটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সার্ভারের তথ্য কিছু সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বিসিসিতে, বাকিগুলো খুব দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হবে বলে আশা করি। বিসিসি আধুনিক সার্ভার ব্যবস্থায় পরিচালনা করবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post