উত্তর থেকে ঝড়ের গতিতে আক্রমণকারীরা এসেছিল। তীর হাতে, ঘোড়ায় চড়ে, তারা হানদের ফসলের ক্ষেতগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। হানরা তাদের দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তারা এতদিন ধরে এই ফসলের ক্ষেতগুলোকে যত্নের সাথে লালনপালন করে আসছিল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০ বছর থেকে।
চীনের হানরা ওই অনুপ্রবেশকারীদের ‘শিয়ানু’ বলে অভিহিত করেছিল, যার অর্থ ‘উগ্র দাস’। বর্বরদের ‘নিকৃষ্টতা’ জোর দিয়ে বোঝাতেই ওই অবমাননাকর শব্দের প্রয়োগ করা হয়।
তবে বাস্তবে সামরিক এবং রাজনৈতিক দক্ষতার নিরিখে তাদের চীনা প্রতিবেশীদের অতিক্রম করেছিল শিয়ানু। বিভিন্ন জাতি ও উপজাতির সমন্বয়ে গঠিত ‘শিয়ানু’ বিশ্বের প্রথম যাযাবর সাম্রাজ্য। তারা এতটাই সুসংগঠিত আর শক্তিশালী ছিল যা চীনের হানদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছিল এবং পরবর্তীতে তাদেরকে চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতেও বাধ্য করেছিল।
দক্ষ শিয়ানু ধনুকধারীদের পেছনে ছিল শক্তিশালী শিয়ানু নারীরা, যারা সাম্রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করেছিল। শিয়ানুর ইতিহাসকে একত্রিত করা কঠিন কাজ ছিল। কারণ সাংগঠনিক, সামরিক দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাদের লিখিত ভাষার বিকাশ ঘটেনি।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের আর্কিওজেনেটিক্স বা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি দলের প্রধান ক্রিস্টিনা ওয়ারিনার বলেন, ‘আমরা শিয়ানু সম্পর্কে যে সব তথ্য জানি তার বেশিরভাগই তাদের সমাধিস্থল এবং শত্রুদের কাছ থেকে আসা।’ সমাধিস্থলগুলো থেকে অনেক উল্লেখযোগ্য তথ্যই পাওয়া যায়, যেমনটা জানা গেছে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা থেকে। ওই গবেষণা মতে, সমাধিস্থলে নারীদের দেহাবশেষই বেশি রয়েছে।
মঙ্গোলিয়ার শিয়ানু সমাধিস্থল খননকারী প্রত্নতাত্ত্বিকরা দীর্ঘ দিন ধরে মনে করে, বেশ কয়েকটি অভিজাত এবং বিস্তৃত সমাধিতে যে দেহাবশেষ পাওয়া গেছে, তার বেশিরভাগই নারীদের। যদিও বছর কয়েক আগে জেনেটিক সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি আসার পরই ওয়ারিনারের নেতৃত্বাধীন দলটি নিশ্চিতভাবে বলতে পেরেছিল যে ওই দেহাবশেষ নারীদের। বিজ্ঞান সাময়িকীতে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে তাদের গবেষণা প্রকাশিত হয়।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর জিওনথ্রোপোলজির প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর এবং ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ মঙ্গোলিয়ার প্রধান জামস্রঞ্জভ বায়ারসাইখান বলেন, ‘আমাদের জিনগত অনুসন্ধান প্রমাণ করে যে অভিজাত রাজকুমারীরা সামাজিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিকভাবে শিয়ানু সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।’
কিভাবে নারীরা শিয়ানুদের অঞ্চল প্রসারিত করতে এবং যাযাবর সাম্রাজ্যকে একত্রিত করতে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখেছিল, সে বিষয়ে এই অনুসন্ধানগুলো বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। সাধারণত আমরা সাম্রাজ্যগুলোকে স্থাবর ভেবে থাকি যেখানে শাসনের সুবিধায় প্রাসাদ, শহর, আদালত, ইত্যাদি বানানো হয়। কিন্তু কিছু যাযাবর সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল বিপুল।
বিখ্যাত চেঙ্গিস খান সাম্রাজ্যের প্রায় এক হাজার বছর আগে, শিয়ানু সাম্রাজ্য ছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত এবং এটি আধুনিক মঙ্গোলিয়ার ওই অঞ্চলটি দখল করেছিল, যার উত্তর সীমানা বর্তমান রাশিয়ার বৈকাল হ্রদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
দক্ষ যোদ্ধা হওয়ার পাশাপাশি শিয়ানুরা বিলাসবহুল পণ্যগুলোর প্রতিও আগ্রহী ছিল। চীনা রেশম, রোমান কাচ, মিসশিয় মালাসহ বিভিন্ন পণ্য ইউরেশিয়া থেকে প্রাচীন সিল্ক রোডের মাধ্যমে নিয়ে আসা হতো। অভিজাত শিয়ানু নারীরা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিল এবং রাজনৈতিক বিষয়েও পারদর্শী ছিল। এক অর্থে শিয়ানু নারীরা ছিল ওই ‘অদৃশ্য আঠা’ বা ‘রেশম সুতা’ যা কোনো স্থায়ী বসবাসস্থল বা শহর না থাকা একটি যাযাবর সাম্রাজ্যকে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ব্রায়ান মিলার ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের সাথেও যুক্ত, তিনি বলেন, ‘শিয়ানু নারীরা সীমান্তে বিশেষ শক্তিশালী পদে ছিল। শিয়ানু ঐতিহ্য বজায় রাখার পাশাপাশি ক্ষমতার রাজনীতি, সিল্ক রোড নেটওয়ার্কের মতো বিষয়েও মাথা ঘামাতো। তারা খুবই সম্মানিত ছিল।’
ক্রিস্টিনা ওয়ারিনার যোগ করেন, ‘নারীদের সমাধি থেকে উদ্ধার করা সামগ্রীগুলো অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতা আর নেতৃত্বের প্রতীক।’ গবেষকরা পশ্চিম মঙ্গোলিয়ার খোভদ প্রদেশের মানখান জেলায় অবস্থিত তাখিলতিন খোতগোরের অভিজাত সমাধিস্থলে স্মৃতিস্তম্ভ খুঁজে পেয়েছেন, যা স্পষ্টতই নারীদের সম্মান জানাতে নির্মিত। সূর্য ও চাঁদের রাজকীয় প্রতীক দিয়ে সজ্জিত কফিনে শায়িত নারীদের সমাধিগুলো সাধারণ পুরুষদের সমাধি দিয়ে পরিবেষ্টিত। একটি স্মৃতিসৌধে ছয়টি ঘোড়াসহ একটি গাড়িও ছিল।
একইভাবে নিকটবর্তী শোম্বুজিন বেলচির সমাধিস্থলে সবচেয়ে অভিজাত সমাধিস্থলগুলো নারীদের, যেখানে তাদের বিলাসবহুল সামগ্রী যেমন চীনা আয়না, সিল্কের পোশাক, কাঠের গাড়ি, জপমালা, উৎসর্গ করা পশুসহ বিভিন্ন বস্তু রাখা রয়েছে। সমাধিগুলো উল্টানো পিরামিডের মতো দেখতে যা মাটির ওপরের দিকে আয়তক্ষেত্রের আকার নিয়েছে (প্রত্নতাত্ত্বিকরা যাকে টেরেস বলেন) এবং ভূগর্ভের দিকে ক্রমশ সংকীর্ণ।
জার্মানির লাইবনেত্জ সেন্টার ফর আর্কিওলজির প্রত্নতাত্ত্বিক উরসুলা ব্রোসেডার বলেন, ‘খননের পর পাওয়া এই সমাধি উল্টা পিরামিডের মতো, যা মাটির ২০ মিটার নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত।’
প্রত্নতাত্ত্বিকরা শিয়ানু সমাধিস্থলে সুন্দর কোমরবন্ধ খুঁজে পেয়েছেন, যা উচ্চ সামাজিক মর্যাদার প্রতীক ছিল।
উরসুলা ব্রোসেডার বলেন, বড় বড় ফলক, পুতি ও পাথরে সজ্জিত কোমরবন্ধগুলো অনেকটা দেখতে ক্রিসমাস ট্রির মতো যার মধ্যভাগ থেকে সুসজ্জিত ঝুলন্ত বস্তু রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কোমরবন্ধ সম্মান আর পদমর্যাদার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক, তবে এটি সাধারণত পুরুষদের ব্যবহারের জন্য, নারীদের জন্য নয়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ওই নির্ধারিত সময়ে শিয়ানু নারীদের কোমরবন্ধ দেয়া হয়েছিল, যদিও পুরুষদের কিন্তু সেভাবে দেয়া হয়নি।’ শিয়ানুদের অন্যতম প্রধান দক্ষতা ছিল ঘোড় সওয়ারি আর তীর-ধনুকের ব্যবহার।
ক্রিস্টিনা ওয়ারিনার বলেন, ‘অনেকে ঘোড়াকে ভূমির জাহাজ বলেন, কারণ শিল্পায়নের আগে জাহাজ আর ঘোড়া ছিল সবচেয়ে দ্রুতগামী।’ শিয়ানুরা ঘোড়াকে গৃহপালিত পশুর মতো লালন-পালন করতো, তারা ‘স্টেপ’ অঞ্চলের বাসিন্দা ছিল এবং ঘোড় সওয়ারির সময় লক্ষ্যবস্তু স্থির করে তীরন্দাজী করাও অনুশীলন করেছিল। ফলে কাছে ও দূরের প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। চীনা হানরা তাদের সমকক্ষ ছিল না।
ওয়ারিনার বলেন, ‘এমন কি যখন তারা চীনের মহাপ্রাচীর তৈরি করেছিল, ওই সময় এটি তেমন কাজ করেনি। শিয়ানুরা শুধু তার চারপাশে ঘুরতো।’
শিয়ানু নারীরা তীর-ধনুক চালানো, ঘোড় সওয়ারিতে পারদর্শী ছিল কিন্তু যুদ্ধের সময় কোনো পুরুষকে অনুসরণ করতো কি-না সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। কিছু নারীর সমাধিতে অশ্বারোহী সরঞ্জাম ছিল, তবে গবেষকরা নিশ্চিত নন যে যুদ্ধক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি লড়াই করেছিল কি-না।
উরসুলা ব্রোসেডার বলেন, ‘আমি মনে করি এই তথ্যটি বাদ দেয়া উচিত নয় যে সেখানে যোদ্ধা হিসেবে নারীরাও ছিল। এর অর্থ এই নয় যে সমস্ত নারীরাই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। তবে তারা অবশ্যই ঘোড়ায় চড়তে ও তীর-ধনুক চালাতে পারতো, যদিও তা হয়তো স্টেপ অঞ্চলে আরো ভালো জীবনযাপনের উদ্দেশে।’
জিনগত গবেষণা ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের দলকে আরো একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য আবিষ্কার করতে সহায়তা করেছিল। চীনের নিকটবর্তী সাম্রাজ্যের সীমান্তে সমাধিস্থ নারীরা জিনগতভাবে আশ-পাশের শিয়ানু জনসংখ্যার চেয়ে খুব আলাদা ছিল। শিয়ানুদের কোনো এক রাজা যার সমাধি ২০১৩ সালে মধ্য মঙ্গোলিয়ায় খনন করে উদ্ধার করা হয়, তার সাথে ওই নারীদের নিকট আত্মীয়তা ছিল বলে মনে করেন গবেষকরা।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post