গত শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) নেটফ্লিক্স মুক্তি দিয়েছে নতুন একটি তথ্যচিত্র, ‘কারি অ্যান্ড সায়ানাইড: দ্য জোলি জোসেফ কেস’। এই তথ্যচিত্রে ভারতীয় নারী জলি জোসেফের জীবনের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে। জলি জোসেফ ছিলেন একজন ঠান্ডা মাথার খুনী। তিনি মিথ্যাকে ধামাচাপা, সম্পদের লোভ এবং বিবাহিত এক ব্যক্তিকে নিজের করে পেতে একে একে ছয় জনকে হত্যা করেছিলেন।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর তথ্য মতে, একটি খুন করে অন্য খুনটি করার আগে বেশ সময় নিতেন জলি জোসেফ; যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে। ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে মোট ১৪ বছরে শ্বশুরবাড়িতে ওই ৬টি খুন করেছিলেন তিনি।
এ বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—জলিকে সবাই খুব হাসিখুশি আর বন্ধুসুলভ হিসেবেই জানত। কেরালার ইদুক্কি জেলার এক ধনি কৃষকের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। নিজের পরিবার থেকে তিনিই প্রথম কলেজে গিয়েছিলেন পড়াশোনা করার জন্য। উচ্চাভিলাষী জোলি খেত-খামারের বাইরে কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন শৈশব থেকেই।
১৯৯৭ সালে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল জোলি জোসেফ এবং রয় থমাসের মধ্যে। রয়ের বাবা টম ছিলেন শিক্ষাবোর্ডের পদস্থ কর্মকর্তা আর মা আন্নাম্মা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। রয়ের ছোট একজন ভাই ও বোনও ছিল। কেরালার কোঝিকোদ জেলার কোদাথাই গ্রামে সম্ভ্রান্ত এই পরিবারটি বসবাস করত।
অল্প সময়ের মধ্যেই জোলি এবং রয়ের মধ্যে ভাব হয়ে গিয়েছিল। সেই বছরের শেষদিকেই তাঁদের রোমান্স বিয়েতে গড়ায়। তবে বিয়ের আগের এবং পরের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। জলি বুঝতে পারেন, হায়দ্রাবাদে চাকরির কথা বললেও রয় ছিলেন আসলে বেকার। সারা দিন বাড়িতে শুয়ে-বসে আলসেমি করে কাটাতেন। মিথ্যা বলেছিলেন জলি নিজেও। কলেজের পড়াশোনা শেষ না করেও এম-কম ডিগ্রি থাকার দাবি করেছিলেন তিনি।
জলির প্রথম শিকার
মিথ্যা ঢাকার জন্যই নিজের শাশুড়ি আন্নাম্মা থমাসকে প্রথম খুন করেছিলেন জলি। এম-কম ডিগ্রির কথা জেনে জলিকে চাকরি কিংবা পড়াশোনা আরও চালিয়ে যাওয়ার তাগাদা দিয়েছিলেন ৫৭ বছর বয়সী আন্নাম্মা। অবসর গ্রহণের পর জলিকে তাগাদা আরও বড়িয়ে দেন তিনি।
এ অবস্থায় আরেকটি মিথ্যার আশ্রয় নেন জলি। দাবি করেন, কোট্টায়াম কলেজে অতিথি লেকচারারের চাকরি পেয়েছেন তিনি। এমনকি কলেজে পড়ানোর কথা বলে তিনি বাড়িও ছেড়ে যান এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ফিরতেন। কিন্তু এই মিথ্যা শাশুড়ির কাছে ধরা পড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করতেন তিনি। তাই ২০০২ সালে শাশুড়িকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা মাথায় আসে তাঁর। সেই মোতাবেক স্থানীয় পশু হাসপাতাল থেকে কুকুর মারার বিষ সংগ্রহ করেন। তারপর ওই বছরেরই ২২ আগস্ট শাশুড়ির স্যুপে এটি মিশিয়ে দেন তিনি। মারা যান আন্নাম্মা।
এবার সম্পদের লোভে
জোলির দ্বিতীয় শিকার ছিলেন তাঁর শ্বশুর ৬৬ বছর বয়সী টম থমাস। বিপুল ভূ-সম্পদ, প্রায় ১৬০০ বর্গমিটার জমির মালিক ছিলেন তিনি।
জলি আশঙ্কা করেছিলেন, আমেরিকা প্রবাসী ছোট সন্তানকে সব উইল করে দিয়ে নিজেও প্রবাসী হয়ে যাবেন টম। তাই বিপুল সম্পদ দখল করতে ২০০৮ সালে আরও একটি হত্যা পরিকল্পনা করেন জলি।
সেই বছর একমাত্র মেয়েকে দেখতে কলম্বো গিয়েছিলেন টম থমাস। কথা ছিল, সেখান থেকে আমেরিকায়ও যাবেন তিনি। কিন্তু নিজের সন্তান গর্ভধারণ এবং স্বামীর মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের খবর দিয়ে টমকে কৌশলে বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন জলি। কৌশলে টমের সম্পদের সব চুক্তিনামাও হস্তগত করেন জলি এবং জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে সব সম্পদ তাঁর স্বামী রয়ের নামে উইল করে দেন। তারপর কাকতালীয়ভাবে সেদিনও ছিল ২২ আগস্ট। শাশুড়িকে হত্যার ঠিক ৬ বছর পরের সেই দিনটিতে শ্বশুরকেও সায়ানাইড বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলেন জলি।
ওই সায়ানাইড ম্যাথিউ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন জলি। ম্যাথিউয়ের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল তাঁর। ম্যাথিউকে বলেছিলেন—তাঁদের সম্পর্কের কথা জেনে গেছেন শ্বশুর টম থমাস। তাই টমকে হত্যার কথা বলে ম্যাথিউয়ের কাছ থেকে সায়ানাইড নিতে সমর্থ হয়েছিলেন।
স্বামীকেও হত্যা
২০১১ সালে জলির পরবর্তী শিকার ছিলেন তাঁর স্বামী রয় থমাস। রয়ের মৃত্যুকেই প্রথমবারের মতো হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। টম থমাসের মৃত্যুর পর সব সম্পদ নিজের দখলে নিয়েছিলেন রয়। তাই রয়কে মেরে ফেলে সব সম্পদ নিজের করে নিতে চাইছিলেন জলি।
২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর বাথরুমের মেঝেতে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় রয় থমাসকে। তাঁর মুখ দিয়ে বমি এবং লালা ঝরছিল। হাসপাতালে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরে হত্যাকাণ্ড সন্দেহে মামা এবং ভাই-বোনদের চেষ্টায় রয়ের মরদেহের একটি ময়নাতদন্ত হয় এবং তার শরীরে সায়ানাইডের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
যদিও পরবর্তীতে জলি পুলিশকে বোঝাতে সক্ষম হন যে—তাঁর স্বামী রয় ছিলেন একজন বিষাদগ্রস্ত মাতাল। তিনি নিজেই নিজের জীবন শেষ করে দিয়েছেন। স্থানীয় পুলিশ এই যুক্তির পর আর জল ঘোলা করেনি। স্বামীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শ্বশুরবাড়ির বিপুল সম্পদে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন জলি।
ধামাচাপার জন্য
তবে বিষয়টির এমন উপসংহারে সন্তুষ্ট ছিলেন না রয়ের মামা ও ভাই-বোন। বিশেষ করে রয়ের মামা রয় ছাড়াও তাঁর বাবা-মায়ের মৃত্যু নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। যা হওয়ার তাই হলো—জলির এবারের টার্গেটে পরিণত হন রয়ের মামা। ২০১৪ সালের একদিন মামা শ্বশুরের সান্ধ্যকালীন পানীয়তে সায়ানাইড মিশিয়ে দেওয়া হয়। অচেতন অবস্থায় পরে তাঁকে জলি এবং প্রতিবেশীরা হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে আরও দুটি হত্যা
এর মধ্যেই জলি আরেকটি বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নন জলির স্বামী রয়ের চাচাতো ভাই সাজু। রয়ের মতো অকর্মণ্য ছিলেন না সাজু। শিক্ষকতার পাশাপাশি আয়ের নানা উৎস ছিল তাঁর। জলি আর সাজু একসঙ্গে বসবাসের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও কয়েকটি বাধা দূর করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
এই বাধাগুলো দূর করতেই ২০১৪ সালের ১ মে সাজুর মেয়ে আলফির শরীরে সায়ানাইড প্রয়োগ করেন জলি। কয়েক দিন পর আলফির মৃত্যু হয়। দেড় বছর পর ২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি সাজুর স্ত্রী সিলিকে দাঁতের ওষুধের সঙ্গে সায়ানাইড মিশিয়ে হত্যা করেন। সিলির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগাগোড়া ছিলেন জলি। সব দায়িত্ব নিজ হাতে সামলেছেন। সাজুর বাড়িতে এ জন্য সকাল-সন্ধ্যা যাতায়াত শুরু হয় তাঁর। ২০১৭ সালেই তাঁরা বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বসবাস শুরু করেন।
তবে এই বেশি দিন টিকতে দেননি জলির প্রয়াত স্বামীর আমেরিকা প্রবাসী ভাই রোজো থমাস। তিনি তাঁর বাবা-মা, ভাই ও মামাসহ প্রত্যেকটি মরদেহের ফরেনসিক তদন্তের জন্য পুলিশকে রাজি করান। ফরেনসিক পরীক্ষায় দেখা যায়, মৃত্যুর আগে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু খেয়েছিলেন এবং প্রত্যেকের শরীরেই সায়ানাইডের উপস্থিতি পাওয়া যায়। আর প্রতিটা মৃত্যুর সময়ই ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিলেন জলি।
জলির প্রেমিক ম্যাথিউর সহায়তায় তিনি স্বামীকে হত্যা করেন। ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর জলিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় সায়ানাইড সরবরাহ করা তাঁর গোপন প্রেমিক ম্যাথিউকেও। দুজনই এখন জেলে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post