নাসা আগামী ২০৩০-এর দশকে হ্যাবিটেবল ওয়ার্ল্ডস অবজার্ভেটরি (এইচডব্লিউও) নামে একটি নতুন টেলিস্কোপ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এ টেলিস্কোপ দিয়ে পৃথিবীর মতো সমধর্মী গ্রহগুলোতে প্রাণের অনুসন্ধান চালানো হবে। এইচডব্লিউও একটি অত্যন্ত শক্তিশালী টেলিস্কোপ হবে। এটি দূরের গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হবে। এছাড়াও এটি গ্রহগুলোর পৃষ্ঠে পানি বা অন্য কোনো প্রাণের অস্তিত্বের লক্ষণ খুঁজে পেতে পারবে।
মহাবিশ্বে অন্য কোনো প্রাণ আছে কি না — এ প্রশ্ন অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানীই বর্তমানে আর জিজ্ঞেস করছেন না। তার বদলে তাদের মনে এখন যে প্রশ্নটা তৈরি হয়েছে তা হলো: আমরা কখন এ প্রাণের খোঁজ পাব?
অনেকেই আশাবাদী আমাদের জীবদ্দশাতেই মহাজাগতিক প্রাণের সন্ধান পাওয়া যাবে, এমনকি এ সন্ধান আগামী কয়েক বছরেই পাওয়া যেতে পারে।জুপিটার নিয়ে একটি গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া একজন বিজ্ঞানী তো এটাও বলেছেন যে, গ্রহটির বরফ ঢাকা অনেকগুলো উপগ্রহের একটিতেও যদি কোনো প্রাণ না থাকে তাহলে সেটাই হবে বরং ‘আশ্চর্যজনক’।
নাসা’র জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) সম্প্রতি আমাদের সৌরজগতের বাইরের একটি গ্রহে প্রাণ থাকার সম্ভাবনার ইঙ্গিত পেয়েছে। এছাড়া এ টেলিস্কোপটি আরও অনেক গ্রহের ওপর অনুসন্ধান চালাচ্ছে। ‘আমাদের এ মহাবিশ্ব অসীম। এর গ্রহ–নক্ষত্রের সংখ্যাও অনন্ত। আর আমাদের অনেকের কাছে এখন এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে এ মহাবিশ্বের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে কেবল আমরাই থাকতে পারি না,’ বলেন স্কটল্যান্ডের অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যাল-এর অধ্যাপক ক্যাথেরিন হেইম্যানস।
দ্য ‘গোল্ডিলকস জোন’
দূরের বিভিন্ন নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তন করা গ্রহের বায়ুমণ্ডলকে বিশ্লেষণ করতে পারে বর্তমান যুগের টেলিস্কোপগুলো। যেসব রাসায়নিক উপাদান কেবল কোনো প্রাণীর পক্ষেই (নিদেনপক্ষে পৃথিবীতে) তৈরি সম্ভব, গ্রহের বায়ুমণ্ডলে সেসব রাসায়নিক পদার্থের অনুসন্ধান করে এসব টেলিস্কোপ।
গত মাসের শুরুতে এ ধরনের অনুসন্ধানের প্রথম চাঞ্চল্যকর সম্ভাবনা পাওয়া যায়। ১২০ আলোকবর্ষ দূরের কে২-১৮বি নামক এক গ্রহের বায়ুমণ্ডলে এমন একটি গ্যাস থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যা পৃথিবীতে সমুদ্রে বাস করা কিছু জীবসত্তা তৈরি করে। গ্রহটি ‘দ্য গোল্ডিলকস জোন’-এ অবস্থিত। যেসব গ্রহ তার নক্ষত্র থেকে এমন একটি উপযুক্ত দূরত্বে অবস্থান করে যেখানে গ্রহটির ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা খুব বেশি গরম বা ঠান্ডা না হয়ে বরং সেটি তরল পানির অবস্থানের জন্য যথেষ্ট হয়, সেগুলো গোল্ডিলকস অঞ্চলে অবস্থানকারী গ্রহ।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অভ অ্যাস্ট্রোনমি’র অধ্যাপক নিক্কু মধুসূদন এ গবেষণাটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ গবেষকদলের প্রত্যাশা, আগামী এক বছরের মধ্যেই জানা যাবে সেখানে আদতেই প্রাণের সম্ভাবনার কোনো পরিবেশ আছে কি না।
মধুসূদন বলেন,
‘আমাদের গবেষণার একদম প্রথম গ্রহটিতে যদি আমরা প্রাণের প্রমাণ পাই, তাহলে মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব একটি স্বাভাবিক ঘটনা — এমন সম্ভাবনা তৈরি হবে।’
তার দল যদি কে২-১৮বি গ্রহে প্রাণের চিহ্ন না পায়, তাহলেও তাদের কাছে গবেষণার জন্য আরও ১০টি গোল্ডিলকস গ্রহ আছে। এসব গ্রহে কোনো প্রাণের সন্ধান যদি নাও পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রেও গ্রহগুলোতে প্রাণ থাকার সার্বিক সম্ভাব্যতা নিয়ে নতুন তথ্য ও ধারণা লাভ করবেন বিজ্ঞানীরা। অধ্যাপক মধুসূদনের মতো আরও অনেক গবেষকই সৌরজগতে ও তার বাইরে দূরের গ্রহে বর্তমানে প্রাণের অনুসন্ধান করছেন।
নাসা’র জেডব্লিইএসটি বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী ও বড় টেলিস্কোপ। কিন্তু গ্রহ থেকে প্রতিফলিত হওয়া মাত্রাতিরিক্ত দীপ্তির কারণে এটির পক্ষে অনেক দূরে অবস্থিত পৃথিবীর মতো ছোট গ্রহে প্রাণের সন্ধান করা সম্ভব নয়। তাই নাসা এ সমস্যা সমাধানে বর্তমানে হ্যাবিটেবল ওয়ার্ল্ডস অবজার্ভেটরি (এইচডব্লিউও)-এর পরিকল্পনা করছে। আগামী ২০৩০-এর দশকে এটির কাজ শেষ হতে পারে। এ টেলিস্কোপ দিয়ে আমাদের পৃথিবীর মতো সমধর্মী গ্রহগুলোতে প্রাণের অনুসন্ধান চালানো যাবে।
এছাড়া এ দশকের শেষভাগে কাজ শুরু করবে এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ (ইএলটি)। এ যন্ত্র চিলির মরুভূমিতে বসানো হবে। এটি সেখান থেকেই দূরের গ্রহে প্রাণ আছে কি না তা জানার চেষ্টা করবে। এ টেলিস্কোপটির আয়না সবচেয়ে বড়, ব্যাস ৩৯ মিটার।
‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’
অনেক গবেষক আমাদের সৌরজগতে এলিয়েন প্রাণের অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। জুপিটারের বরফে ঢাকা একটি উপগ্রহ ইউরোপায় প্রাণ থাকার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। এটির বরফপৃষ্ঠের তলায় একটি সমুদ্র রয়েছে। নাসা’র ক্লিপার এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ)-এর জুপিটার আইসি মুনস এক্সপ্লোরার (জুস) উভয় মিশনই ২০৩০-এর দশকের শুরুতে উপগ্রহটিতে পৌঁছাবে। ২০১২ সালে জুস মিশনের অনুমোদন দেওয়া হয়।
শনি গ্রহের টাইটান উপগ্রহে ড্রাগনফ্লাই নামক একটি নভোযান পাঠাচ্ছে নাসা। এ উপগ্রহে কার্বনসমৃদ্ধ রাসায়নিক উপাদানে তৈরি হ্রদ ও মেঘ রয়েছে। পানির পাশাপাশি এ রাসায়নিক উপাদান প্রাণধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করছেন বিজ্ঞানীরা।
এলিয়েন কি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে?
অনেক বিজ্ঞানী এ প্রশ্নকে এখনো সায়েন্স ফিকশনের জগতের বলে বিবেচনা করলেও ভিনগ্রহ থেকে কোনো রেডিও তরঙ্গ আমাদের গ্রহে আসছে কি না তার অনুসন্ধান গত এ দশক ধরে চলছে। এ কাজে অগ্রগণ্য দ্য সার্চ ফর এক্সট্রা টেরেসট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এসইটিআই) নামক একটি ইনস্টিটিউট।
মহাশূন্যের আয়তন অসীম হওয়ায় এ ধরনের অনুসন্ধান এলোমেলোভাবে চালানো হচ্ছে। কিন্তু জেডব্লিউএসটি’র মতো টেলিস্কোপগুলো এখন মহাশূন্যে প্রাণধারণের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান চিহ্নিত করতে পারছে। তাই এসইটিআই’র মতো উদ্যোগগুলো এখন তাদের অনুসন্ধান আরও নির্দিষ্ট করে চালাতে পারবে।
এসইটিআই’র কার্ল সেগান সেন্টার-এর পরিচালক ড. নাথালি ক্যাবরল বলেন, ‘এলিয়েনের অস্তিত্ব অনুসন্ধান করতে এলিয়েনের পাঠানো বার্তার সন্ধান করাটা কিছুটা অস্বাভাবিক শোনালেও এটি ঘটা অসম্ভব কিছু নয়।’ ‘ভাবুন তো একবার, এমন একটা সিগন্যাল পাওয়া গেল যেটা আমরা বুঝতে পারলাম,’ বলেন এ জ্যোতির্জীববিজ্ঞানী।
৩০ বছর আগেও মানুষ মহাশূন্যে অন্য নক্ষত্রকে আবর্তন করা কোনো গ্রহের কথা জানত না। বর্তমানে পাঁচ হাজারের বেশি এমন গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব গ্রহ নিয়ে নজিরবিহীন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণা করতে পারেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্জীববিজ্ঞানীরা।
কে২-১৮বি নিয়ে গবেষণা করা দলটির সদস্য ছিলেন কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শুভজিৎ সরকার। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি প্রাণের চিহ্ন পাই, এটি হবে বিজ্ঞানের জন্য এক নতুন বিপ্লব। আর মানুষ নিজেকে যেভাবে দেখে বা মহাবিশ্বে নিজের অবস্থানকে যেভাবে বিবেচনা করে, তা-তেও বড় পরিবর্তন আসবে নতুন প্রাণের সন্ধানে।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post