ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর রক্তের সম্পর্ক রয়েছে! অবাক করা এমন খবর প্রকাশ করেছে আল-ওসবো নামের মরক্কোর একটি সংবাদপত্রে। আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী গণমাধ্যম ডেইলি মেইলের খবরে বলা হয়, বর্তমান ব্রিটিশ রাজবংশীয়রা চৌদ্দ শতকে আর্ল অফ কেমব্রিজের বংশের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই আর্ল বা সামন্ত বংশ স্পেনের প্রথম ইসলামি রাজবংশের সঙ্গে রক্তবন্ধন যুক্ত। কারণ স্পেনে ইসলামি শাসনের গোড়াপত্তন করেছিলেন নবী-কন্যা ফাতিমার বংশধর।
ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে গবেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, নবী মুহাম্মদ (সা.) এর রক্তধারার ৪৩তম প্রজন্ম হচ্ছেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। যদি এই দাবি সত্য হয়, তাহলে জর্ডান ও মরক্কোর রাজবংশ এবং ইরানের বিখ্যাত নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিও রানী এলিজাবেথের খুব কাছের আত্মীয়।
এই দাবির সত্যতা নিয়ে ইউরোপ ও আরব উভয় দিকের ইতিহাসবিদরাই বিভিন্ন প্রকারের মতপোষণ করতে শুরু করেছেন। একদল ইতিহাসবিদ জানাচ্ছেন, জাইদা নামে স্পেনের ইসলামি রাজবংশের এক রাজকন্যা সেভিল শহর বর্বরদের দ্বারা আক্রান্ত হলে এগারো শতকে সেখান থেকে পালাতে বাধ্য হন এবং কাস্তাইয়ের খ্রিস্টান রাজা ষষ্ঠ আলফোনসোর কাছে আশ্রয় নেন। সেখানেই জাইদা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। তার নতুন নাম হয় ইসাবেলা। তিনি আলফোনসোকেই বিয়ে করেন এবং তাদের এক পুত্রসন্তান হয়। সেই পুত্রেরই কোনো বংশধর কেমব্রিজের আর্লকে বিয়ে করেন।
জাইদার বংশপরিচয় নিয়ে ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত নন। তবে অনেকেই তাকে মহানবীর বংশধর মুহাম্মদ বিন আব্বাদের বংশধর বলে মনে করেন। আবার অনেকের মতে, জাইদার সঙ্গে মুহাম্মদ বিন আব্বাদের বংশের কারোর বিয়ে হয়েছিল। উল্লেখ্য, বিষয়টি আরব বিশ্বে বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট আলেম ডক্টর আব্দুস সালাম আজাদি বলেন, “আমি এই কথাটি প্রথম শুনি ২০০৪ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। আমার বন্ধু ও শিক্ষকতুল্য ডঃ ডেভিড রোসার ওয়েন (শায়খ দাঊদ) বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ট্রেনিং সেশনে লাঞ্চের সময় এই কথা আমাদের বলছিলেন। স্যাটানিক ভার্সেস লেখার পর সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে বৃটেনের সমস্ত মুসলিম জনগণ একাট্টা হয়ে যায়। ঐ সময় জর্ডানের বাদশাহ হুসায়ন ইংল্যান্ডে আসতে চান। কিন্তু বৃটেনের ইন্টেলিজেন্ট তার আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছিলোনা। এ কথা রাণীর কাছে পৌঁছলে তিনি কর্তা ব্যক্তিদের ডাকেন এবং বিষয়টির কারণ অবগত হতে চান। তখন তাকে জানানো হয় বাদশাহ হুসাইন নবী (সা) বংশের। তিনি এসে যদি কোন ভাবে স্যাটানিক ভার্সেস নিয়ে কোন বিরূপ মন্তব্য করেন, তাহলে খোমেনির ফাতওয়ার পর এটা আরেক ঝামেলা তৈরি করবে। এটা শুনে নাকি রাণী মন্তব্য করেন, বাদশাহ হুসাইন নবী বংশের হলে সো আই আম!! (আমি ও তো তাই)। এটা নিয়ে তখন মিডিয়া মহলে বেশ কথা ওঠে।
মূলত তিনি নবীর (স) এর রক্ত ধারার কিনা এটা নিয়ে “পিয়ার্ক নবেলিটি” গ্রুপ প্রথম কথা বলে। যারা বৃটেইনের রাজবংশের ইতিহাস গবেষক হিসেবে পরিচিত। তারা ১৮২৬ এই সম্পর্কে লিখেন যে বৃটেইনের এই রাজবংশ ইশবেলিয়ার রাজাদের সাথে সম্পৃক্ত। এটা স্পেনের বংশ লতিকার ইতিহাসের দলীল দস্তাবেজ দিয়েও প্রমাণিত। এই বিষয়টি জোরে শোরে বাজার পায় যখন ১৯৮৬ ঐতিহাসিক হ্যারোল্ড ব্রুকস বেইকার তার Burke’s peerage, Britain’s guide to the nobility প্রকাশ করেন। এই বইটা তৎকালীন বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী মার্গারেট থেচারের হাতে দিয়ে তাকে বলেন, “It is little known by the British people that the blood of Mohammed flows in the veins of the queen,”
এরপরে বিষয়টি the Economist এ ছাপানো হয়। ঐ সময় এটা মরক্কোর “আল উসবু’ আলমাগরিবিয়্যাহ”তে আব্দুল হামিদ আল আউনী এটা প্রমাণ করে দেখান যে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ স্পেনের আব্বাদী বংশের মু’তামিদ এর কন্যা যায়দার রক্ত ধারা থেকে এসেছেন, যিনি তার বাবার পরাজয়ের পর পালিয়ে ক্যাস্টাইলের রাজা আলফান্সোর আশ্রয়ে যান এবং তাকে বিয়ে করেন।
এই যায়দা ছিলেন ফাতিমা (রা) এর ছেলে হাসান (রা) এর পুত্র হুসায়নের মেয়ে আযযহরা (ফাতিমা)র অধঃস্তন সন্তান। এই বিষয়টি আরো জোর পায় মিশরের গ্রান্ড মুফতি আলী জুমআহ এ ব্যাপারে ইতিবাচক অভিমত দিলে এবং রাণীর জন্য দুয়া করলে। এরপর অনেক দিন বিষয়টা আলোচনায় আসেনি। অতি সম্প্রতি বৃটেইনের রয়্যাল ফিচার রাইটার জেনিফার নিউটন ২০১৮ সালে How the Queen could be related to Prophet Muhammad due to possible Spanish ancestor নামে একটা ফিচার লেখেন। সেই থেকে বিষয়টা নিয়ে গরম হয়ে ওঠে।
রাণীর যে বংশ লতিকা প্রাসাদে রক্ষিত আছে সেখানে দেখানো হচ্ছে এই ভাবে: (ছবিতে বংশ লতিকা দেয়া হলো)
১- মুহাম্মাদ (সা)
২- আলী + ফাতিমা
৩- হাসান বিন আলী
৪- হুসাইন ইবন হাসান
৫- যাহরা (ফাতিমা) বিনতে হুসাইন
৬- নাঈম আললাখমী ইবন যাহরা
৭- দ্বিতীয় নাঈম বিন নাঈম
৮- ইতলাফ ইবন নাঈম
৯- আমর ইবন ইতলাফ
১০- আসলাম ইবন আমর
১১- আমর ইবন আসলাম
১২- আব্বাদ ইবন আমর
১৩- কুরায়শ ইবন আব্বাদ
১৪- ইসমাঈল ইবন কুরায়শ
১৫- আবুল কাসিম মুহাম্মাদ ইবন ইসমাঈল (ইশবেলিয়ার রাজা)
১৬- আব্বাদ (২) আল মু’তাদিদ ইবন মুহাম্মাদ
১৭- আলমু’আতামিদ ইবন মু’তাদিদ আব্বাদ
১৮- যায়দা বিনতে মু’তামিদ এর স্বামী রাজা আলফান্সো
১৯- রোডরিকস , আলফানসোর ছেলে
২০- soncha daughter of Rodriquez
21- Aldonza Gonsalez Daughter of Soncha
22- Aldonza Romirez daughter of Aldonza Gonsalez
23- Maria Femandez daughter of Aldonza Romirez
24- Maria Juana daughter of Maria Femandez
25- Isabella Perez daughter of Maria Juana
26- Richard, Earl of Cambridge son of Isabella Perez
26- Richard Plsatagenet son of Richard
27- Edward (IV) son of Richard Plsatagenet
28- Elizabeth Daughter of Edward (IV)
29- Margaret Tudor daughter of Elizabeth
30- James (V) son of Margaret Tudor
31- Mary Queen daughter of James
32- James (VI) son of Mary Queen
33- Elizabeth daughter of James (VI)
34- Sophia daughter of Elizabeth
35- George (I) son of Sophia
36- George (II) son of George (I)
37- Fredrick Son of George (II)
38- George (III) son of Fredrick
39- Edward son of George (III)
40- Victoria Queen Daughter of Edward
41- Edward (VII) son of Victoria
42- George (V) son of Edward (VII)
43- George (VI) son of George (V)
44- Elizabeth (II) daughter of George (VI)
এই হিসেবে কাসতালিয়ার রাজা আলফান্সো ও যায়দার ঘরে জন্ম নেয়া মেয়ে সানচোর মাধ্যমে যে আর্ল ক্যামব্রিজ রাজবংশের পত্তন হয়, সেখান থেকেই আসেন রাণী এলিজাবেথ। নবী (স) এর বংশের সাথে রাণীর বংশের এই খবর প্রকাশের পর বিশ্ব মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। অনেকেই এটা অস্বীকার করেন, আরবদের অনেকেই স্বীকার করেন। তবে সামগ্রিক মুসলিম বিশ্ব থাকে নিশ্চুপ।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই বংশ তালিকার ব্যাপারে সন্দিহান। কারণ হুসাইন বিন হাসান বিন আলীর ঘরে যাহরা নামে কোন মেয়ের নাম পাওয়া যায়না। যদিও ফাতিমা নামের এক মেয়ে ছিলো বলা হয়। যাই হোক, এই ব্যাপারে আল্লাহ ভালো জানেন। কিন্তু এই নবী (সা) এর বংশের সাথে রাণীর বংশের মিল হলে আমাদের আসে যায় কি? আমি গত ২০ বছর এই দেশে আছি। দেখেছি আন্তঃধর্ম শান্তির ব্যাপারে রাণীর ভূমিকা অত্যন্ত ভালো। যে সব মুসলিম এই দেশে আছে তাদের সার্বিক কল্যানার্থে রাণীর ভূমিকা প্রসংশার্হ। যদিও মুসলিম বিশ্বের সাথে বৃটেইনের সম্পর্কোন্নয়নে তাঁর ভূমিকা কতটুকু তা আমি জানিনা। রাণী ৮/৯/২০২২ এর দুপুর ২টার দিকে মৃত্যুবরণ করেছেন।
আমাদের নবী (সা) একবার এক ইয়াহুদির লাশ নিয়ে যেতে দেখে দাঁড়িয়ে যান। তাঁকে বলা হলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ, এটা একজন ইয়াহুদির লাশ। তিনি বলেছিলেন, আ- লাইসাত নাফসান? “এ কি মানুষ নয়”? আমাদের শায়খ ইবন বায (র) ও কাফিরের লাশ হলেও দাঁড়ানো জায়েজ বলেছেন। আমি তাই এদেশের নাগরিক হয়ে তার মৃততে শোক জ্ঞাপন করছি। এই দেশের জন্য রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অবদান ইতিহাস হয়ে থাকবে। ৭৬ বছর নির্বিঘ্নে তিনি দেশ চালিয়েছেন, এবং এদেশের আপামর জনসাধারণের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন।”
বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেম শোলাকিয়া ইদগাহ-এর গ্র্যান্ড ইমাম, ইকরা বাংলাদেশের প্রিন্সিপাল মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, বংশগতভাবে তিনি নবী কারিম সা. এর বংশের হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আমরা এ বিষয়ে গবেষকদের আলোচিত বংশধারা যাচাই করে বুঝতে পারবো বিষয়ের সত্যতা কতটুকু। রানীর বংশ জার্মান থেকে এসেছে। রাসুলের বংশের সঙ্গে মিললে আশ্চর্যের কিছু না। আর যায়দা বিবির কথা বলা হয়েছে তিনি কী আসলেই ইসলাম ধর্মের থেকে খ্রিষ্টধর্মে গিয়েছেন কী না আমরা ইতিহাস থেকে যাচাই করেই বলতে পারবো।
রাজধানী ঢাকার জামিয়া শায়খ জাকারিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল, বিশিষ্ট বক্তা, লেখক গবেষক, মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, ইউরোপিয় গবেষকরা ইতিহাস ঘেঁটে বের করেছে রানী এলিজাবেথ রসুল সা. এর বংশের। হ্যাঁ এমন হতে পারে অস্বাভাবিক কিছুই না। তবে আমরা বিষয়টা পর্যালোচনা না করে কিছু বলতে পারছি না। ইতিহাস অনেক বড় বিষয় এটা নিয়ে পাঠ প্রয়োজন।
আরো পড়ুন:
ছুটিতে দেশে এসে সৌদি প্রবাসীর মৃত্যু
বেড়েছে প্রবাসী আয়, রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলার
হুন্ডিতে টাকা নিলে বিপদে পড়বেন প্রবাসীর স্বজন
মৃত্যুকূপ পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছেছে ৩৮ বাংলাদেশি
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post