ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে মাসে কোটি টাকার ওপরে ঘুষ লেনদেন হয়। আর এই টাকা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু দালালদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে থাকে। নতুন পাসপোর্টের আবেদন ও সংশোধনকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে দালালরা এই টাকা নিয়ে থাকে। দালাল ছাড়া পাসপোর্ট সংক্রান্ত কোনও কাজই হয় না এখানে। পুরাতন দালালের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন দালালও। বছরের পর বছর ধরে অফিসটি চিহ্নিত দালালের কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়ে রয়েছে। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে দালালদের গ্রেফতার করলেও তাদের দৌরাত্ম্য থামছে না। নিজস্ব অনুসন্ধান ও একটি সংস্থার গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিষয়টি নিয়ে পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল নুরুল আনোয়ারের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিনিয়ত আমরা দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে থাকি। এরপরও দালালের উৎপাত কমে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দালালদের গ্রেফতারের জন্য আমরা সবসময় অনুরোধ করে থাকি।
তবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেয়ারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। আমাদের যে কয়েকটি সেবা খাতে দুর্নীতি হয় তার মধ্যে পাসপোর্ট অন্যতম। এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া দালালরা কোনভাবেই এ ধরনের অপকর্মে জড়িত হতে পারে না। শুধু যে ঢাকা বিভাগীয় তা নয়, সারা দেশের পাসপোর্ট অফিসের একই চিত্র। বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট হয় সেখানে কিছু ত্রুটি ইচ্ছে করেই রাখা হয়েছে যাতে দুর্নীতি করার সুযোগ থাকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিদিন ঢাকা বিভাগীয় অফিসে আবেদনকারী-দর্শনার্থী মিলে ২/৩ হাজার লোক আসে। এর মধ্যে নতুন পাসপোর্ট ও পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন জমা পড়ে ৫শ’র বেশি। এ হিসেবে মাসে ১৫ হাজারের কিছু বেশি জমা হয়। জানা গেছে, এখানে শতকরা ৯০ শতাংশ দালাল আবেদনকারীদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করে কাজ বাগিয়ে নেয়। তারা প্রতি পাসপোর্টের পেছনে ৩/৪ হাজার টাকা করে নিয়ে থাকে। সবমিলিয়ে মাসে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এ পাসপোর্ট অফিসকেন্দ্রিক নতুন পুরাতন মিলে ২৩ জনের দালাল সিন্ডিকেট রয়েছে। আর এই সিন্ডিকেটের প্রধান হলো জীবন সিকদার। এছাড়াও মামুন সিকদার (জীবনের ভাই), সোহাগ (জীবন ও মামুনের ভাই), নুরজ্জামান, রফিক, জাকির হোসেন শহীদুল, জুয়েল রানা, জুলমত খান, তানজীনা আকতার, এলাহী, রেজাউল ইসলাম, আব্দুল মোল্লা, রাজু, নয়ামিয়া, কুবাদ সিকদার, সোহেল, শাহীন সিকদার, রাশিদা, শিপন খান, মো. মহসিন, মো. নুরে আলম খোকন, মো. খোরশেদ ও মো. চান মিয়া।
সরেজমিন দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের সামনে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৯০ জন দালাল জড়ো হয়ে পাসপোর্ট করতে আসা প্রার্থীদের সাথে পাসপোর্ট অফিসের অনিয়ম ও হয়রানির কথা বলে প্রার্থীদের চেইন সিস্টেমের প্রস্তাব দেয়। চেইন সিস্টেম হলো সরকারি ফি (জরুরি ৮০৫০ টাকা এবং অতিজরুরি ১০৩৫০ টাকা) বাদে অতিরিক্ত টাকা প্রদান অর্থাৎ প্রতি আবেদনে ১৪/১৫ হাজার টাকা দিলে দালালরা অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে যোগসাজশে প্রার্থীর আবেদন করা থেকে ভেরিফিকেশন এবং পাসপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত সকল কাজ করে দেওয়ার একটি প্রস্তাব। দালালদের এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে হয়রানি এড়ানোর জন্য প্রার্থীরা চেইন সিস্টেম অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। একজন প্রার্থী সকাল ৯টায় পাসপোর্ট অফিসে এলে আবেদনপত্র জমা দিতে লাইনে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে সংযুক্ত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই এবং ছবি তোলা পর্যন্ত বিকাল হয়ে যায়। এত লম্বা সময় লাইনে দাঁড়িয়ে না থেকে সহজেই পাসপোর্ট কার্যক্রম শেষের জন্য দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত চাঁদা দিয়ে চেইন সিস্টেমের শরণাপন্ন হন। দালালরা অফিসের অসাধু কর্তাদের সাথে যোগসাজশে প্রার্থীদের লাইনে না দাঁড়িয়ে আবেদনপত্র বিশেষ ব্যবস্থায় অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে সহজেই জমা দেওয়ার কার্যক্রম শেষ করে।
জানা যায়, একজন আবেদনকারী অনলাইনে আবেদনের পর পাসপোর্ট অফিসে আবেদন জমাসহ ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর অনলাইনে পাসপোর্ট দেওয়ার দিন ধার্য হয় প্রায় দেড় থেকে দুই মাস পর। এই সময়টি অনেক দীর্ঘ হওয়ায় আবেদনকারী দালালদের শরণাপন্ন হন। তখন একজন দালাল প্রতি পাসপোর্টে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বাড়তি নিয়ে এখানকার কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কাজ করে দিয়ে থাকে। এছাড়াও আবেদনকারী ই-পাসপোর্টের জমা দিতে গেলে পূর্বের পাসপোর্টে নাম “বড় মোহাম্মদ এবং বর্তমান জাতীয় পরিচয়পত্রে ছোট মো. থাকলে আবেদনকারীকে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়”। পাসপোর্ট অফিসের কেউ পরিচিত থাকলে এর সমাধান ২/৩ দিনে হয়ে যায় আর প্রার্থীর কোনও যোগাযোগ বা অবৈধভাবে টাকা না দিলে এই সমস্যা সমাধানে তাকে ২/৩ মাস অপেক্ষা করতে হয়। ই-পাসপোর্ট আবেদনকারী ছবি তোলার জন্য লাইন ধরে থাকতে হয় তবে যোগাযোগ করলে বা পাসপোর্ট অফিসের পরিচিত বা অবৈধভাবে টাকা দিলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ছবি তোলা হয়ে যায়। এছাড়া যেসকল প্রবাসী বিদেশ থেকে পাসপোর্টের আবেদন করেন বছরের পর বছর পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট পাসপোর্ট অফিসে আসার পরেও পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষ আপডেট করতে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করে। আবার কখনও যোগাযোগ করলে তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট প্রিন্ট করে বিদেশে প্রেরণ করেন।
ভুক্তভোগী আসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, দালাল ছাড়া আমরা অসহায়। দালাল ছাড়া আপনি কাজ করতে গেলে এমন হয়রানির মধ্যে ফেলে যে একটা লোক আর কোনও দিন পাসপোর্ট করতেই আসবে না। আর দালাল ধরলে সকল সমস্যার সমাধান। আমরা এখানে দালালদের টাকা দিতেই হবে, এটি মেনেই এসেছি।
তিনি বলেন, দালাল তো আর একা টাকা খায় না, এদের মাধ্যমে কর্মকর্তারা নেয়। এ কারণে তারাই পাসপোর্ট অফিসে দালাল পোষে থাকে।
একই অভিযোগ করেন পাসপোর্ট করতে আসা আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখানে দালাল না ধরলে কাজ কবে সম্পন্ন হবে এটা কেউ বলতে পারে না। আর দালাল ধরলে নির্ধারিত দিনের আগেই কাজ শেষ হয়। এ কারণে অনেকেই পাসপোর্ট অফিসে আসার পর ইচ্ছে করেই দালাল খোঁজে।
তিনি বলেন, কর্মকর্তারা দালালমুক্ত করে যদি সদিচ্ছায় কাজ করেন তবে পাসপোর্ট করতে সাধারণ মানুষ দালাল ধরবে না।
তবে এই বিষয়ে ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা দালালদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছি। পাসপোর্ট করতে আসা লোকজন যেন দালালদের খপ্পরে না পড়ে সেজন্য আমরা মাইকিং করছি। কিছু দালালদের ছবি টাঙ্গিয়ে তাদের ব্যাপারে সতর্ক করা হচ্ছে।
লাইনে দাড়িয়ে সিরিয়াল অনুযায়ী ছবি তোলা হচ্ছে। তবে ব্যাংকে টাকা জমাদানের ব্যাপারে যিনি পাসপোর্ট করতে আসবেন তার সেটা নিজস্ব ব্যাপার।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।
Discussion about this post