ব্যাগেজ রুলসের সুবিধা নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে গড়ে উঠেছে চোরাকারবারিদের বিশাল সিন্ডিকেট। বিদেশ থেকে আসা একজন যাত্রী কী আনতে পারবেন, তা রয়েছে ব্যাগেজ রুলস বা বিধিমালায়। মূলত এ সুবিধায় আনা শত শত মণ স্বর্ণ চোরাকারবারিদের হাতে তুলে দিচ্ছে এক শ্রেণির যাত্রীরা। আর এই স্বর্ণগুলোই নানান কৌশলে সীমান্ত পার হয়ে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।
বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এ রকম যাত্রীদের শনাক্ত করতে কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েক শ’ ব্যক্তিকে— যারা নিয়মিত দুবাই বা সৌদি আরব গিয়ে স্বর্ণ এনে দেশে চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেয়। আর এদের ব্যাপারেই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সংস্থাটি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, আমরা এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। বিমানবন্দরে কাস্টমসের কাজ অটোমেটেড সিস্টেমে করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কিছু সম্পন্ন হয়েছে। পুরোপুরি সম্পন্ন হলে আমরা এক যাত্রীকে একবার, দুইবার, সর্বোচ্চ তিনবার দেখবো। এরপর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একটা সময় দেখা যাবে— সে আর দেশের বাইরেই যেতে পারছে না। আমরা সেই বিষয়টির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
যারা নিয়মিত দুবাই এবং সৌদি আরব যাতায়াত করেন। এরা ব্যাগেজ রুলসের সুবিধা নিয়ে দেশে স্বর্ণ এনে চোরাকারবারিদের হাতে তুলে দেয়। এই ২০ ব্যক্তির মধ্যে পাঁচ জন মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার। এদের বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান চালায় ।
পাসপোর্টের সূত্র ধরে মুন্সীগঞ্জের শিলিমপুরের সিরাজের খোঁজ নেওয়া হয়। গ্রামে ঢুকে স্থানীয়দের কাছে সিরাজের খোঁজ করতেই লোকজন পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার লোক মনে করে বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ করতে থাকে। এক পর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়।
কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মাঝ বয়সী লিটনের সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রামে সিরাজ স্বর্ণের কারবারে জড়িত হিসেবেই দীর্ঘদিন পরিচিত। এমনকি বাহক হিসেবে কাজ করে অনেকের স্বর্ণ মেরে দেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। যাদের স্বর্ণ মেরে দিয়েছে তারা মাঝে-মধ্যে গ্রামে আসে। এ কারণে তার খোঁজ করতে গ্রামে যখন কেউ আসে লোকজন ভাবে হয়তো তারও স্বর্ণ মেরে দিয়েছে।
লিটন জানান, সে গ্রামে খুব কম থাকে। শ্বশুর বাড়ি লৌহজংয়ের দিকে বেশি থাকে। সে দীর্ঘদিন স্বর্ণ আনে। তবে সে কোথায় কার কাছে এগুলো দেয়— গ্রামের কেউ জানে না।
গ্রামের বাসিন্দা শাহারিয়ারও প্রায় একই কথা বলেন। তিনি বলেন, অনেক লোক তার সম্পর্কে জানতে আসে। আসলে সে একজন স্বর্ণ চোরাকারবারি। বিদেশ থেকে স্বর্ণ এনে চোরাকারবারিদের হাতে দেয়।
সিরাজের বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী নিলুফার আক্তার বলেন, তিনি বাড়িতে নেই। কোথায় আছেন তিনি তা জানেন না। এমনকি কখন আসবেন সেও তিনি জানেন না।
স্বর্ণের এই কারবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তা অকপটে স্বীকার করেন।
সদর উপজেলার দক্ষিণ মহাকালী এলাকার আলমাস ব্যাপারী সম্পর্কে খোঁজ নিতে যাওয়া হয় সেই গ্রামে। এই গ্রামের লোকজনও তাকে স্বর্ণের ব্যবসায়ী হিসেবে চেনে। গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, আমরা তাকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী হিসেবে চিনি। অনেক দিন ধরে এই ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, এখনও উনি গ্রামে নেই। দুবাই আছেন।
মালেকের দেওয়া তথ্যে আমরা সরাসরি চলে যাই আলমাস ব্যাপারীর বাড়িতে। সেখানে তার স্ত্রী আকলীমা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমার স্বামী তো অন্যায় কিছু করে না। আর এখন কয়েক মাস বন্ধও আছে। তিনি দেশের বাইরে আছেন।
আলমাস ব্যাপারীর সঙ্গে ফোনে কথা হয় । তিনি বলেন, এখন তিনি দুবাইয়ে রয়েছেন। স্বর্ণ আনার বিষয়টি অকপটে স্বীকারও করেন। তবে এখন কিছুদিন বন্ধ রেখেছেন বলে জানান তিনি। স্বর্ণগুলো কার কাছে দেন বা কত টাকা পান সে ব্যাপারে কথা বলতে গেলে তিনি এড়িয়ে যান।
মুন্সীগঞ্জ সদরের মুক্তারপুর থেকে অতি সন্নিকটে ভট্টাচার্য্যের বাগ এলাকার মোখলেসুর রহমানের বাড়ি। গ্রামে ঢুকে তার খোঁজ করতেই একই কথা জানান স্থানীয়রা। অবশ্য দুই দিন আগেই দেশে ফেরা মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
সাংবাদিক পরিচয় জানতেই কিছুটা রেগে যান তিনি। তিনি বলেন, আমরা সরকারি ট্যাক্স দিয়েই স্বর্ণ আনি। এরপর আমি কোথায় দিলাম না দিলাম এটা দেখার কেউ নাই। যদি এগুলো দেশের বাইরে পাচার হয় তাহলে সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করুক। তিনি এর চেয়ে বেশি আর কোনও কথাই বলতে রাজি হননি।
মুন্সীগঞ্জ টঙ্গিবাড়ি থানার আব্দুল্লাহপুরের রুহুল আমিনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। লোহজংয়ের কে এম নিয়াজ হাফিজের ক্ষেত্রেও একই। অর্থাৎ, তারা গ্রামে বা এলাকায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী হিসেবেই দীর্ঘদিন পরিচিত।
এদিকে, মুন্সীগঞ্জ ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের ডালিম মিয়া, নবীনগরের আব্দুল হক মিলন, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার আল মামুন, টাঙ্গাইলের করটিয়ার জকি ঘোষ এবং ঝালকাঠি সদরের শামসুল হকের বিষয়েও বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান চালানো হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে তাদের মাসে ৩/৪ বার দুবাই যাওয়া-আসা করার আর্থিক সঙ্গতি নেই। পারিবারিকভাবে তারা অবস্থাসম্পন্ন ছিলেন না। এমনকি তাদের পক্ষে পাসপোর্ট করার টাকাও জোগাড় করা অসম্ভব ছিল। অথচ মাসে ২ বার, কখনও ৩ বার যাতায়াতের রেকর্ড তাদের রয়েছে। এই চক্রটিই বার বার দুবাই বা সৌদি গিয়ে স্বর্ণ এনে তুলে দিচ্ছে চোরাকারবারিদের হাতে।
ব্যাগেজ রুলসের সুবিধার আড়ালে তারা মণের পর মণ স্বর্ণ আনছে। আর এগুলোই চলে যাচ্ছে দেশের সীমান্ত পার হয়ে অন্য দেশে।
জানা যায়, ব্যাগেজ রুলসের আড়ালে শাহজালাল কেন্দ্রিক চোরাকারবারিদের বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেছে। স্বর্ণের চোরাকারবারিরা বিভিন্ন লোকদের পাসপোর্ট-ভিসা বানিয়ে দিয়ে স্বর্ণ আনা নেওয়া করছে। কিন্তু তারা আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
কাস্টমসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর ট্যাক্স দিয়েই দেশে স্বর্ণ আসে প্রায় ৪ হাজার কেজি। সেই হিসেবে গত ৫ বছরে দেশে স্বর্ণ এসেছে ২০ হাজার কেজি। অথচ সরকারিভাবে আমদানি করে স্বর্ণ আনার পরিমাণ একেবারে নগণ্য।
বিমানবন্দর কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার আল-আমিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সোনা পাচার হয়ে যাওয়ার কারণে পূর্বে ট্যাক্সসহ ২টি সোনার বার আনার অনুমতি ছিল। আমরা সেটি কমিয়ে ১টি সোনার বারে এনেছি। এখন কোনও প্রবাসী বা কোনও যাত্রী যদি একটি সোনার ট্যাক্স পরিশোধ করে বাইরে নিয়ে যান এক্ষেত্রে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। আমাদের দেখার বিষয়টি হলো— তিনি কাস্টমস হলে সোনার বিষয়টি ডিক্লেয়ার করেছেন কিনা। যদি কর পরিশোধ করেন, তাহলে তিনি সেটি বৈধভাবে নিয়ে যেতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রত্যেক যাত্রী যদি একটি করে সোনার বার নিয়ে আসেন এবং যদি তারা ট্যাক্স পরিশোধ করেন— এ নিয়ে আমাদের আর করার তেমন কিছু নেই। পরবর্তীতে তিনি ওই বার কী করলেন বা কী কাজে ব্যবহার করলেন— এটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় না। এটি দিয়ে যদি কোনও অপরাধ বা দেশের বাইরে পাচার করে বা করতে চায় সেটি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিষয়।
তবে তিনি বলেন, এই সুযোগ আর বেশিদিন পাবে না। অচিরেই এটি বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা এ ব্যাপারে অ্যাকশনে যাবো।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বলেন, যে পরিমাণ সোনা দেশে ঢুকছে সেগুলো দেশে থাকলে আমাদের জন্য ভালো হতো, আমরা কম দামে সোনা বিক্রি করতে পারতাম। কিন্তু এগুলো চোরাকারবারির মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশে এত সোনা থাকলে নিশ্চয়ই দামও কমতো।
বিজিবি সদর দফতরের উপ-মহাপরিচালক কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, সোনাসহ যে কোনও চোরাচালানের বিরুদ্ধে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে চোরাচালান রোধে সীমান্তে নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নিয়ে অভিযান পরিচালনা করছি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post