শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি এখন চরমে। বিমানবন্দরের ভিতরে-বাইরে কোনো স্থানেই যাত্রীদের নিস্তার নেই।
কনকর্স হল, মূল ভবন, ইমিগ্রেশন পুলিশ, কাস্টমস পোস্টসহ ঘাটে ঘাটে চলে হয়রানির মচ্ছব। তুই তোকারি থেকে শুরু করে চরম অসৌজন্যমূলক আচরণের পাশাপাশি হুমকি ধমকিতে যাত্রীদের আতঙ্কিত করে তোলা হচ্ছে। নানারকম ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া যাত্রীদের টাকা পয়সা, মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে অহরহ। ভিআইপি সিআইপি যাত্রীরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। চরম বিড়ম্বনার শিকার হয়ে বিমানবন্দর ছাড়তে হচ্ছে তাদের। নজিরবিহীন এমন কর্মকাণ্ড শুধু এক দিনই নয়, এমন হয়রানির ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, হয়রানির হাজারো অভিযোগ নিয়ে একের পর এক বৈঠক, মন্ত্রী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সিভিল এভিয়েশনের কড়া তদারকি, প্রশাসনিক নজরদারিসহ গোয়েন্দা বিভাগগুলোর নানামুখী তৎপরতায়ও হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বন্ধ হচ্ছে না। যারা যাত্রীদের হয়রানিমুক্ত করার দায়িত্বে নিয়োজিত তারাই উল্টো যাত্রী হয়রানির কর্মকাণ্ডে মেতে ওঠেছেন। কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বেরিয়ে আসার মুহূর্তেও দেশে ফেরত বিজনেস ক্লাস যাত্রীদের আটকে দেওয়া হয় নানা অজুহাতে। যা বিশ্বের সভ্য কোনো দেশেই সম্ভব নয়।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত ও নাজেহালের শিকার হচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে কর্মরত বাংলাদেশিরা। তারা দেশে ফেরা ও কর্মস্থলের উদ্দেশে দেশত্যাগ- উভয় ক্ষেত্রেই চরম হয়রানির শিকার হন। যাদের কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে, সেই প্রবাসী কর্মজীবীদের সঙ্গে কাস্টমস বিভাগের আচরণ আরও রুঢ়, আরও ন্যক্কারজনক। বিমানবন্দরে কাস্টমস চেকিং পয়েন্টে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী বাঙালিদের পাসপোর্ট হাতে নিয়েই লাগেজ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। দায়িত্বরত একশ্রেণির কর্মকর্তার প্রথম প্রশ্ন থাকে- ‘কয় বছর পর দেশে আসলি, আমাদের জন্য কী আনছস-দে তাড়াতাড়ি।’ ভুক্তভোগী যাত্রীরা মানসম্মানের দিকে তাকিয়ে বিদেশি মুদ্রা হাতে গুঁজে দিয়েই দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার পথ খোঁজেন।
বিমানবন্দর এলাকায় গত কয়েকদিন সরেজমিন অনুসন্ধানকালে যাত্রী হয়রানির নানা বেহালচিত্র লক্ষ্য করা গেছে। সম্প্রতি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই ভুক্তভোগী কয়েকজন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে নানা অভিযোগ করেন। তবে সামাজিক সম্মান ও পরিচিতির কারণে নিজেদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করতে রাজি হননি তারা। বিমানবন্দরে যাত্রীদের আকুতি-মিনতি, অভিযোগের কোনো পাত্তা মেলে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যাত্রীদের ভাগ্যে জোটে নির্দয় আচরণ। বিমানবন্দরে যাত্রীদের দৈহিক নির্যাতন চালানোর বেশ কয়েকটি ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু সবকিছুর ব্যাপারে সিভিল এভিয়েশন অথরিটির চরম দায়িত্বহীনতায় দিন দিনই পরিস্থিতি চরমে পৌঁছেছে। যাত্রী ভোগান্তি দূর করার পরিবর্তে অথরিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উল্টো অভিযোগকারীকেই নানা ফাঁদে ফেলে হয়রানি করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্ভাগা যাত্রীদের অভিযোগ, বিমানবন্দরের বাইরের তুলনায় ভিতরে ঘাটে ঘাটে হয়রানি-ভোগান্তির মাত্রা কয়েক গুণ বেশি। যাত্রী সেবায় নিয়োজিত ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, বিমানবন্দর পুলিশ, কাস্টমসসহ বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরতদের একটা বড় অংশই নিয়মিত যাত্রী হয়রানি করছে। বিমানবন্দর অভ্যন্তরের অন্তত ১২টি ধাপে যাত্রীদের কাছ থেকে চাহিদামাফিক টাকা হাতানোর ধান্দায় নানারকম হয়রানি চালানো হয়। বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে থাকা ব্যাংকের বুথে মুদ্রা সংগ্রহ করতে গিয়েও চরম হয়রানির শিকার হতে হয়।
মুদ্রা সংগ্রহে গেলে ব্যাংক থেকে জানানো হয়, সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রা নেই। শেষ মুহূর্তে ব্যাংকের আশপাশে অবস্থানকারী অবৈধ মুদ্রা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় দেশের মুদ্রা মাত্রাতিরিক্ত দামে সংগ্রহে বাধ্য হন যাত্রীরা। বিদেশ ফেরত যাত্রীরা দুই পর্বে ১২-১৩টি ধাপে হয়রানির শিকার হন। কাস্টমস হলরুম থেকে বের হওয়ার পর ট্যাক্সিচালক, দালাল এমনকি ছিঁচকে চোরের খপ্পরে পড়েও তাদের নাস্তানাবুদ হতে হয়।
যাত্রীরা বিদেশ গমনের সময় বহিরাগমন লাউঞ্জের প্রবেশমুখে কর্তব্যরত একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর খপ্পরে পড়েন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে টার্গেটকৃত যাত্রীদের পাসপোর্ট, টিকিট ইত্যাদি চেক করাকালে জানানো হয়, তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্ট রয়েছে। অতএব কোনোক্রমেই তিনি দেশ ছেড়ে যেতে পারবেন না। বিমানে ওঠার চূড়ান্ত মুহূর্তে এমন অভিযোগের কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। দিশাহারা যাত্রী আকুতি-মিনতি করতে থাকেন। এ অবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করার নামে যাত্রীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
বেল্টে লাগেজ ওঠানোর সময় যাত্রীদের কাছে অল্প পরিমাণে অতিরিক্ত মালামাল থাকলেও শুরু হয় আরেক ধরনের হয়রানি। টাকা দিয়ে সমঝোতা করে তবেই বোর্ডিং পাস ইস্যু করাতে হয়, অন্যথায় মালামাল সেখানে ফেলেই চলে যেতে হয় যাত্রীদের। বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের লাগেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে অযথা প্রচুর সময়ক্ষেপণ করানো হয়। সেখানে সাধারণ যাত্রী বা বিজনেস ক্লাসের যাত্রী হিসেবে আলাদা কোনো কদরও পায় না। সবাইকে এক পাল্লায় মেপে অভিন্ন আচরণের পাঁয়তারা চলে।
যাত্রীদের লাগেজ সংগ্রহের জন্য বেল্টের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করানোর ঘটনাও ঘটে। সময়ক্ষেপণের ফাঁকেই সংঘবদ্ধ চক্রটি লাগেজ গায়েব, লাগেজ কেটে ভিতরের মালামাল সরিয়ে নেয়। এ ছাড়া লাগেজ আসেনি বলে জানানো এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরে যোগাযোগ করার কথা বলে সাদা কাগজের চিরকুটে দায়িত্বরত কর্মকর্তার মোবাইল নম্বর লিখে দিয়েই যাত্রীকে বিদায় করা হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় হয়রানির নানা ধাপ। কয়েক দফা বিমানবন্দরে ঘোরাঘুরি করানোর একপর্যায়ে টাকা লেনদেনের বিনিময়ে লাগেজ দেওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে।
ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানান, মূলত ইমিগ্রেশন পুলিশের হয়রানির শিকার হয়ে বহির্গামী যাত্রীদের নাভিশ্বাস ওঠে। দেশ থেকে যাওয়া অল্পশিক্ষিত প্রবাসী যাত্রীদের নানা প্রশ্ন করে তাদের আটকে রাখাটা এখানে অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে ইমিগ্রেশন পুলিশের দক্ষতা নিয়েও। লাগেজে দামি মালামাল থাকলে তো কথাই নেই। যাত্রীর মালামাল স্ক্যানিংয়ের নামে গ্রিন চ্যানেল অতিক্রম করতে অযথাই দেরি করানো হয়।
তবে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা বলছেন, মাত্র ২২টি কাউন্টারেই যাত্রীসেবার সব কাজ সম্পন্ন করা হয়। সেখানে নতুন কাউন্টার বসানোরও জায়গা নেই। পিকআওয়ারে যখন ৫-৬টি বিমান স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অবতরণ করে তখন যাত্রীদের দীর্ঘলাইনে দাঁড়াতে হয়। তবে বেশির ভাগ যাত্রীরাই নিয়মকানুন না জানার কারণে অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, তাদের কারণেই তারা ভোগান্তির শিকার হয়। শুধু ইমিগ্রেশন নয়, শাহজালালের প্রতিটি ঘাটেই যাত্রীদের নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়।
এদিকে কাস্টম হয়রানি এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। বিমানবন্দরে আর্মড পুলিশের দায়িত্ব হলো বহির্গমন, পার্কিং লট, ক্যানোপি, কনকর্স হল, আগমনী কনভেয়ার বেল্ট, টারমাক, রানওয়ে, ড্রাইওয়ে ও অ্যাপ্রোন এলাকায় নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকা। তবে তারা অধিকাংশ সময়ই ব্যস্ত থাকে আগমনি আর কার পার্কিং এলাকায় যাত্রীদের মালামাল তল্লাশির কাজে।
বিদেশ থেকে আসা অনেক যাত্রী বিমানবন্দরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে গাড়িতে ওঠার পরই এই আর্মড পুলিশের তল্লাশির মুখোমুখি হন। টানাহিঁচড়া করে আবার বিমানবন্দরের ভিতরে নেওয়ার নজিরও আছে। এপিবিএন পুলিশ ও সিভিল টিম সদস্যরা শাহজালালে বহির্গমন যাত্রীদের ভিসা, পাসপোর্ট, টিকিট চেকিংয়ের নামে এসব হয়রানি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ দায়িত্ব ইমিগ্রেশন পুলিশের হলেও তারা অনধিকার চর্চা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে আর্মড পুলিশ কর্তৃক নিরাপত্তাবিষয়ক অতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে যাত্রী হয়রানি বেশি হচ্ছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post