মালদ্বীপের এক নাগরিককে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর একজন বাংলাদেশিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনাটি মালদ্বীপের ইতিহাসে প্রথম, যেখানে একজন বাংলাদেশি নাগরিককে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেওয়া হলো।
২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মালদ্বীপের ফৌজদারি আদালত শাহ আলম মিয়া ওরফে সেলিম মিয়া নামে ওই প্রবাসী বাংলাদেশিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।
দীর্ঘদিন ধরে সেলিম মিয়া তার সাজার বিরুদ্ধে আদালতে কোনো আপিল দাখিল না করায়, বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সেলিমের সাজার বৈধতা নিশ্চিত করতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। এ তথ্য নিশ্চিত করে স্থানীয় গণমাধ্যম দ্য এডিশন। পরে আদালতের শুনানিতে প্রবাসী সেলিম তার দোভাষীর মাধ্যমে অনুরোধের প্রেক্ষিতে, সব তদন্তের সত্যতার ভিত্তিতে এবং বিচারকের সহায়তায় তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার প্রস্তাব আনেন আদালতে!
মালদ্বীপের আলিফ ধালু ধানগেঠি আইল্যান্ডের স্থানীয় ব্যবসায়ী মাহমুদ আবু বকুর হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি প্রবাসী সেলিম মিয়া (২৯)। বাংলাদেশে তার বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার লাখাইল উপজেলার কামালপুর গ্রামে।
২০২১ সালের অক্টোবরে ফৌজদারি আদালত মালদ্বীপের নাগরিক মাহমুদকে নির্মমভাবে হত্যা এবং দ্বীপে একটি পরিত্যক্ত প্লটে তার মরদেহ ফেলে রাখার সব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন সেলিমকে। মালদ্বীপের ইতিহাসে এটিই প্রথম কোনো বিদেশিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়ার ঘটনা।
রাষ্ট্র নিযুক্ত আসামিপক্ষের আইনজীবী আহমেদ শফিউ বলেন, সেলিম হাইকোর্টের সঙ্গে নতুন তথ্য শেয়ার করতে চান। এতে সেলিমের আইনজীবী সতর্ক করেছেন যাতে সেলিম আদালতে মিথ্যা বক্তব্য না দেন। তবুও সেলিম বক্তব্য দিতে চাইলে বিচারকের বেঞ্চ বলেন, আইনজীবী এবং তার আসামির মধ্যে ভাগ করা তথ্য গোপনীয়, যা আদালতে প্রকাশ করা যাবে না।
সেক্ষেত্রে আসামিপক্ষের আইনজীবী যদি মনে করেন, তিনি তার মক্কেলের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না বা তার অনুরোধগুলো পূরণ করতে পারবেন না; তাহলে তার পক্ষে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত। এসময় বিচারকের বেঞ্চ প্রবাসী সেলিমকে জিজ্ঞেস করেন তার পক্ষে নতুন কোনো আইনজীবী চান কিনা।
জবাবে সেলিম চিৎকার করে বলেন, ‘আমি নতুন আইনজীবী চাই না। আমি আর কোনো বিচারও চাই না। তবে আমার অনুরোধ আপনাদের কাছে, সাজাটি যেমন আছে তেমনই বহাল রাখুন। এর কারণ হলো আমি আজ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি। কর্তৃপক্ষের কেউই আমার বক্তব্য গ্রহণ করছে না। আমি অনুরোধ করছি নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হোক। এবং এর কোনো পরিবর্তনের দরকার মনে করছি না।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত কিছুক্ষণের জন্য মুলতবি ঘোষণা করা হয়। পুনরায় শুনানি শুরু হওয়ার পর, বেঞ্চ আবারও সেলিমকে নতুন আইনজীবী দেয়ার প্রস্তাব দেন। তারা সেলিমকে ব্যাখ্যা করেন যে তাকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, নিম্ন আদালতের রায় সম্পর্কে তার কাছে এমন কিছু আছে কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়। সেলিম প্রতিক্রিয়ায় জানান, এই বিষয়ে তার আর কোনো অভিযোগ নেই। তবে তিনি তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতার প্রস্তাব দেয়ার কারণে সম্ভাব্য নম্রতার জন্য আবেদন করেছিলেন।
কিছুক্ষণ পর সেলিম আবারও তার অবস্থান পরিবর্তন করে বিচারকের কাছে দাবি করেন, নিম্ন আদালত তাকে কিছু মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। বিস্তারিত জানতে চাওয়া হলে বলেন, তিনি যে অপরাধ করেননি তা স্বীকার করতে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল। পরে বিচারকের বেঞ্চ সেলিমকে জিজ্ঞাসা করেন তার কোন বক্তব্য তদন্ত ও নিম্ন আদালত খারিজ করেছে।
সেলিম জবাবে বলেন, নিম্ন আদালতে যখন তার মামলা চলছিল, তখন তিনি দিভেহি ভাষা বুঝতেন না বা বলতেন পারতেন না। তবে তিনি মালদ্বীভিয়ান ওই ব্যবসায়ীকে হত্যা করেননি বলে জানান। সাজা কমিয়ে দেশে পাঠানো হবে এই আশ্বাস পেয়ে, দোভাষীর শেখানো কথায় তিনি হত্যার অভিযোগ স্বীকার করেন বলে জানিয়েছেন আদালতকে। এজন্য দোভাষী পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছিলেন তখন। এরপরই নিম্ন আদালত মালদ্বীপে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করে নতুন দোভাষী নিয়োগের জন্য, সেলিমকে হাইকোর্টে দরখাস্ত জমা দেয়ার পরামর্শ দেন।
তবে মালদ্বীপের বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সেলর মো. সোহেল পারভেজ গণমাধ্যমকে জানান, প্রবাসী সেলিম মিয়ার অনুরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনজীবী নিয়োগসহ আগের দোভাষীর পরিবর্তে তার পছন্দমতো বাংলাদেশি একজন দোভাষী পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারপরও কেন সে আদালতে এ ধরনের আচরণ করছে, তা বোধগম্য নয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সেলিমের জন্য নতুন নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশি দোভাষী এ এইচ শরিফ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যতটুকু বুঝতে পারলাম সেলিম মানসিকভাবে খুব অসুস্থ। তাকে বারবার সংযত হয়ে আদালতে কথা বলতে বললেও, চিৎকার আর চেঁচামেচি করে শেখানো কথার প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলেছে রায় বহাল রাখতে। তার প্রতি বিচারকরা নমনীয় ছিল এবং বারবার আইনজীবী পরিবর্তন করা লাগবে কিনা জানতে চাইলেও সেলিম না বলেছে। এখন অপেক্ষা আগামী তারিখে কী সিদ্ধান্ত দেয় হাইকোর্ট বেঞ্চ।’
বিচারক বেঞ্চ, মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে সেলিম অবগত ছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, সাজা ঘোষণার সময় থেকে অনেক দিন পর তিনি তা জানতে পেরেছেন। বিচারক বেঞ্চ, এই বিষয়ে সেলিমের কাছে তার চূড়ান্ত বক্তব্য জানতে চাইলে সেলিম জানান, তিনি সুস্থ নন, তবে আদালতে দেয়া তার প্রস্তাবে কী সহযোগিতা করা লাগবে জানতে চান।
রাষ্ট্রপক্ষ বা ভিকটিমের আইনজীবী আদালতে বলেন, আসামি এমন সময়ে তার অপরাধ স্বীকার করেছিল যখন তার সব অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। আসামির জন্য একজন দোভাষী পরিবর্তন এবং রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবীর পরিষেবাও দেয়া হয়েছিল। তবে ভিকটিমের নিকটবর্তী পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী এবং ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী, সেলিমকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। কারণ, সেখানে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি নেই। তারা সেলিমের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার জন্য পুনরায় আবেদন করেন।
সব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেশটির হাইকোর্ট বেঞ্চ ঘোষণা করেছেন যে, মামলাটির আর কোনো স্পষ্টীকরণের প্রয়োজন না হলে পরবর্তী শুনানিতে রুল ঘোষণা করা হবে। হাইকোর্ট বেঞ্চের তিন বিচারপতির মধ্যে ছিলেন বিচারক ফাতিমাথ ফারুহিজা, বিচারক মোহাম্মদ নিয়াজ এবং সভাপতিত্বকারী বিচারক হাসান শাফিউ।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post