বাংলাদেশিরা দেশে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন কমিয়েছে। তবে দেশের বাইরে, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বাড়ছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে দেশটি। আগস্টে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের দিক থেকে ইউএই ছিল সপ্তম স্থানে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারসংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে ইউএইতে বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ডে খরচ করেছিলেন ২৭ কোটি টাকা। সেই খরচ সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ কোটি টাকায়। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে দেশটিতে ক্রেডিট কার্ডে বাংলাদেশিরা ১২ কোটি টাকা বা ৪৪ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ করেছেন। ইউএই ছাড়া ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ যেসব দেশে বাংলাদেশিরা বেশি অর্থ খরচ করেন, সেখানে এক মাসের ব্যবধানে খরচের ক্ষেত্রে এত বেশি তারতম্য হয়নি।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশিদের নতুন গন্তব্য হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাই। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশও এখন দুবাইয়ে আবাস গড়ে তোলার পাশাপাশি ব্যবসাও করছে। যদিও বৈধ পথে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া বিদেশি ব্যবসা বা বাড়ি কেনার জন্য অর্থ স্থানান্তরের কোনো সুযোগ নেই। আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হলেও নানা উপায়ে বাংলাদেশিরা এখন ইউএইর বিভিন্ন শহরে নানা ধরনের ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের সাম্প্রতিক গন্তব্য হয়ে উঠেছে দেশটি।
এদিকে দুবাই চেম্বার অব কমার্সের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে। এই ছয় মাসে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন ১ হাজার ৪৪টি কোম্পানি দুবাই চেম্বারের সদস্যপদ নিয়েছে। তাতে দুবাই চেম্বারের সদস্যপদ পাওয়া বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন কোম্পানির মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৭৫।
এ ছাড়া ৬ নভেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফের সঙ্গে এক বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, দুবাইয়ে ১৩ হাজার কোম্পানি খুলেছেন বাংলাদেশিরা, প্রতিজন ৫ কোটি টাকা করে বিনিয়োগ করেছেন। পর্তুগালে আড়াই হাজার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন। প্রত্যেকে ৫ লাখ ইউরো করে বিনিয়োগ করেছেন। এই অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে।
এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের ভ্রমণ বেড়েছে। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। ফলে দেশটিতে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশে বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়লেও দেশের ভেতরে ক্রেডিট কার্ডে অর্থ খরচ কমেছে সেপ্টেম্বরে। দেশের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটায় সেপ্টেম্বরে ক্রেডিট কার্ডে অর্থ খরচ হয়েছে ২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। আগস্টে যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে দেশের ভেতরে ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটায় খরচ কমেছে প্রায় ১৮৯ কোটি টাকা বা পৌনে ৮ শতাংশ। তার বিপরীতে বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে খরচ বেড়েছে ১৯ কোটি টাকা বা সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি।
গত আগস্টের মতো সেপ্টেম্বরেও বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ডে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেছেন ভারতে। এরপর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এ দুই দেশে বাংলাদেশিরা সেপ্টেম্বরে খরচ করেছেন ১৪২ কোটি টাকা। এই দুই দেশের পর বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ডের বেশি ব্যবহার করেছেন ইউএই, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরে। আর দেশের বাইরে ক্রেডিট কার্ডে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, খুচরা দোকান ও ফার্মেসিতে।
ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী দেশের ৪৩টি ব্যাংক ও ১টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংক এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। গত মঙ্গলবার টি প্রকাশ করা হয়।
কোন দেশে কত খরচ
গত সেপ্টেম্বরে দেশের বাইরে বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ ৭৩ কোটি টাকা খরচ করেছেন ভারতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৯ কোটি টাকা খরচ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তালিকায় পরের দেশগুলো হলো ইউএই, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বের আরও কিছু দেশে খরচ করা হয়েছে ৫৬ কোটি টাকা।
দেশ-বিদেশে কোথায় কত খরচ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে-বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। সেপ্টেম্বরে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে খরচ করা হয়েছে মোট ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে খরচ হয়েছে ১২৭ কোটি টাকা।
এরপর দেশ-বিদেশ মিলিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থ খরচ হয় খুচরা দোকান বা রিটেইল আউটলেটে, যার পরিমাণ ৩৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশের খুচরা দোকানে খরচ হয়েছে ২৮৯ কোটি টাকা আর বিদেশের খুচরা দোকানে ৭৫ কোটি টাকা। এর বাইরে ছিল পরিষেবা বিল, নগদ উত্তোলন, ফার্মেসি, পোশাকের দোকান, অর্থ স্থানান্তর ও পরিবহন খাতে খরচ।
গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশিরা বিদেশে গিয়ে ক্রেডিট কার্ডে নগদ উত্তোলন করেছেন প্রায় ২৫ কোটি টাকা। আর দেশের ভেতরে নগদ উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ১৯৪ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে ডলার খরচ বেড়েছে। তবে দুবাইয়ে অস্বাভাবিকভাবে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারের পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, তা বাংলাদেশ ব্যাংক খতিয়ে দেখতে পারে।’
কারণ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ডের পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রবণতাটি বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। এমনকি দুবাই চেম্বারেও বাংলাদেশিদের সদস্যপদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পুরো বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।
Discussion about this post