এক বছর আগে নারায়ণ দাশ ওমানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানতেন যে, ওমানে গেলে ভালো চাকরি পাওয়া যাবে এবং ভালো টাকা আয় করা যাবে। কিন্তু স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে প্রবাসে যাওয়ার কথা ভেবে তার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। বারবার পেছনে ফিরে প্রিয়মুখগুলো দেখছিলেন। কিন্তু পরিবারের সমৃদ্ধির কথা ভেবে নিজেকে শক্ত রেখেছিলেন।
প্রবাসে উপার্জন করে প্রিয়জনদের ভবিষ্যৎ গড়ার আশায় হাসিমুখে বিদায় নিয়েছিলেন। ঠিক এক বছর পরের অবস্থা। নারায়ণ দাশ বাড়িতে ফিরে এলেন। এবার আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারলেন না, লুটিয়ে পড়লেন। যে স্ত্রী-সন্তানসহ স্বজনরা ভবিষ্যতের সুখের কথা ভেবে তাঁকে বিদায় জানিয়েছেন, সেই তাঁদেরই চিরতরে বিদায় জানাতে হবে তাঁকে। কারো মুখেই নারায়ণকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা ছিল না।
নারায়ণ দাশ স্ত্রী ও চার সন্তানসহ সাত স্বজনকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। সকাল পৌনে ১১টায় ওমান থেকে বাড়িতে আসার পর থেকে কোনো কথা বলতে পারছিলেন না।
গত মঙ্গলবার হাটহাজারীর মির্জাপুর বোর্ড স্কুল এলাকায় যাত্রীবাহী বাস ও অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে নারায়ণের পরিবারের পাঁচজনসহ সাতজন নিহত হন। খবর পেয়ে গতকাল সকাল পৌনে ১১টায় বাড়িতে পৌঁছেন। এরপর স্ত্রী-সন্তানদের মৃতদেহ দেখে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
কাঁদতে পারছিলেন না, কথাও বলতে পারছিলেন না। চোখেও পানি ছিল না। অনেকটা পাথরের মতো হয়ে পড়েন। দুপুর ১টা থেকে নিহত সাতজনের মরদেহ ক্রমান্বয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সৎকার করা হয়। প্রথমে স্ত্রী রিতা দাশ, মেয়ে শ্রাবন্তী দাশের লাশে আগুন দিয়ে সৎকারকাজের সূচনা করেন নারায়ণ।
অন্য তিন শিশুসন্তান বর্ষা দাশ, দীপ্ত দাশ ও দিগন্ত দাশকে সমাহিত করা হয়। নারায়ণের বড় ভাই শম্ভু দাশের ছেলে বিপ্লব দাশের লাশ দাহ করেন তাঁর ছোট ভাই। নারায়ণের বড় বোন চিনু দাশের লাশ উপজেলার সাতবাড়িয়ায় শ্বশুরবাড়ির শ্মশানে সৎকার করা হয়।
নারায়ণের স্বজনরা জানায়, স্ত্রী-সন্তানের সুখের কথা চিন্তা করে নিজ এলাকায় ধোপার কাজ ছেড়ে ওমানে পাড়ি জমিয়েছিলেন নারায়ণ দাশ। তখন তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না, পরম মমতায় গড়া সংসার তছনছ হয়ে যাবে। প্রিয় স্ত্রী-সন্তানের মুখ চিরতরে হারিয়ে ফেলতে হবে। ঘাতক বাসটি মুহূর্তে কেড়ে নিল নারায়ণ দাশের স্ত্রী, চার সন্তান ও দুই স্বজনের তাজা প্রাণ। এখন তাঁর পরিবারে আর কেউ নেই। একা হয়ে গেলেন নারায়ণ দাশ।
একমাত্র উপার্জনকারী ছেলে বিপ্লব দাশকে হারিয়ে অসুস্থ শম্ভু দাশ শয্যাশায়ী। বিপ্লবের অনুপস্থিতিতে তাঁদের পরিবারে আয়-রোজগারের আর কেউ রইল না। তাঁর মা কাঞ্চনবালা দাশ গিলাফ ধরে কান্নার সুরে এসব কথা বলছিলেন। তাঁদের কান্নায় প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে জল গড়ায়। স্বজনদের মধ্যে অনেকেই আর্তনাদ করছিল, আবার কেউ কেউ নির্বাক তাকিয়ে ছিল। কেউ কেউ কিছুক্ষণ পর পর চিৎকার করে কাঁদছিল।
নারায়ণ দাশের স্ত্রী রিতার দাদি পরলোকগমন করায় নারায়ণের শ্বশুরবাড়িতে অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
আপনার মন্তব্য: