লেবাননের গৃহযুদ্ধের অবসানের কয়েক বছর পর যখন মনে হতে থাকে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত চিরতরে কবরে চলে গেছে শেকড়সমেত, তখনো ভেতরকার চিত্র ছিল আগের মতোই। লেবানিজ এক নারীর বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কার চমকে দিয়েছিল সবাইকে! ঐ নারী ছিল আমার খুব কাছের মানুষ। তার কথাবার্তায় অবাক হয়েছিলাম আমিও। তাকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, যুদ্ধের শঙ্কা জাগায়—এমন কোনো গভীর সমস্যা, সংকটাবস্থা কিংবা বিভাজন বৈরুত ভূখণ্ডে রয়ে গেছে কি না? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘লেবাননে গৃহযুদ্ধের কবর রচিত হয়েছে—এ কথা না মেনে উপায় নেই।’ বৈরুতের বাসিন্দা ঐ নারীর পরের কথাগুলো ছিল অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ—‘…কিন্তু আপনি যদি সত্য বলার জন্য আমাকে খুব করে চেপে ধরেন, আমি একটা কথাই বলব বারবার—‘সমস্যা এখনো রয়েছে এবং সম্ভবত তা আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রকট!’
লেবানিজ নারীর কথার তাত্পর্য আজকের দিনে আরো বেশি স্পষ্ট। সত্যি বলতে, তার কথাগুলো আমার মধ্যে গঠনমূলক সচেতনতাবোধ জাগিয়ে তুলতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আমি তার কথার মানে বুঝি এ রকমভাবে, বিভিন্ন অঞ্চলে ছাইচাপা আগুন যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে—সামান্য খঁড়কুটো পেলেই পুড়িয়ে মারবে গোটা অঞ্চলকে!
মধ্যপ্রাচ্যে আমরা কী দেখে আসছি? এই অঞ্চলের মাটিতে কোনো ধরনের অস্থিরতা দেখা দিলেই তা থেকে সৃষ্টি হয় বড় ধরনের অস্থিরতা। অর্থাত্ লেবানিজ নারীর কথার মর্ম সবার বুঝতে পারার কথা। আরো স্পষ্ট উদাহরণ আছে— ‘আরব বসন্ত’। এই অভ্যুত্থান বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল, দেশগুলোর ভেতর ও বাইরের দৃশ্যপট কত আলাদা! আরব বসন্তে এমন সব প্রতাপশালী নেতাকে পড়ে যেতে দেখা যায় ক্ষমতার চেয়ার থেকে এবং ক্ষমতাধর সব রাষ্ট্রকে যেভাবে অগ্নিলাভা উদিগরণ করতে দেখা যায়, যা গভীরভাবে নাড়া দেয় বিশ্বকে। অথচ অভ্যুত্থানের আগেকার সময়ে সর্বদাই মনে হতো, এসব অঞ্চলে কোনো সমস্যাই নেই। চিরতরে ঘুমিয়ে গেছে সংঘাত-সংকট!
এতক্ষণ তো ইতিহাসের পাঠ শোনালাম। বর্তমান বিশ্বের অবস্থা কী? এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিই-বা কোন পথে? যখন এসব অঞ্চলে স্থিতাবস্থার কথা বলা হচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে শক্তিগুলোকে আবার সংগঠিত হতে দেখা গেল! হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অনেকে বলছেন, আরব বসন্তকে ইতিহাসের সিন্দুকবদ্ধ ফাইলে বন্দি করা গেছে—এমন চিন্তাকে শতভাগ নির্ভুল বলার সময় এখনো আসেনি। সত্যিই কি তাই?
বর্তমান সময়ে মিশরের মতো দেশেও প্রায়ই গণ্ডগোল দেখা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে শক্তিশালী ক্র্যাকডাউন চোখে পড়ছে বটে, কিন্তু যে কোনো সময় সুপ্ত আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটবে—এমন আশঙ্কাও সরানো যাচ্ছে না মাথা থেকে। মিশরের মতো সংকটাবস্থায় হাবুডুবু খাচ্ছে আরো কিছু দেশ। পরিস্থিতি এমন, যে কোনো সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে! জলজ্যান্ত উদাহরণ হিসেবে হামাস-ইসরাইল সাম্প্রতিক সংঘাতের কথা বলা যায়। চলমান ‘ফিলিস্তিন ইস্যু’ কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, এখন পর্যন্ত তা বলা মুশকিল।
আমরা দেখে আসছি, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত চলছে বছরের পর বছর ধরে। হয়তোবা কিছু সময়ের জন্য আগুনকে ছাইচাপা দিয়ে রাখা হয় বা হচ্ছে, কিন্তু এই ঝামেলা কি পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে? একটা সময়ে ইসরাইল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে ধারাবাহিক শান্তি ও স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়ে আসে, কিন্তু চলমান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আবারও লক্ষ করা গেল—এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার দরজা খুলতে এক মুহূর্তও লাগে না!
দুঃখজনক সত্য হলো, ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাণ হারিয়েছে বহু ফিলিস্তিন। আবার যুদ্ধের ময়দানেই জন্ম নিয়েছে বহু প্রাণ। অর্থাত্ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চলছে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত। এই সংঘাত থেকে যারা বেঁচে ফিরছে, তারাও একটা সময়ে এসে নিজের দেশের জন্য রক্ত ঝরাচ্ছে। এখন প্রাণ বিসর্জন দিতে ঘর ছাড়ছে শেষ প্রজন্ম। অর্থাত্ একটা বিষয় পরিষ্কার, ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের যুদ্ধ সব সময়ই ‘হারানোর বড় কারণ’।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এবারের হামলার পেছনে হামাসের সম্ভবত এমন উদ্দেশ্য ছিল, ইসরাইলের ভেতরে-বাইরে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করা। ইসরাইল ভূখণ্ডে এমনভাবে ব্যাঘাত ঘটানো, যাতে করে আরব বিশ্বের একটা বড় অংশ ইসরাইলের পালটা আঘাত তথা, প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। চিন্তা ছিল, এর ফলে এমন ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটবে চারিদিক থেকে, যা নির্ধারণ করে দেবে—এই অঞ্চলের গুরুতর সমস্যা তথা, ফিলিস্তিনসংকট চিরতরে কবরে ঢুকবে কি না?
লক্ষ করার বিষয়, হামাসের হামলার পর পালটা তীব্র আঘাত এসেছে ইসরাইলের পক্ষ থেকে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা হয়েছে। বহু ফিলিস্তিনের প্রাণ গেছে। ধ্বংস হওয়ার উপক্রম গাজা উপত্যকা। অর্থাত্ হামাসের সিদ্ধান্ত যে মারাত্মকভাবে বুমেরাং হয়েছে, তা একদম স্পষ্ট।
হামাসের হামলার লক্ষ্য পূরণ হলো কি না, সেটা বড় কথা নয়। বড় বিষয় হলো, কিছু একটা তো ঘটছেই ভেতরে ভেতরে! গভীরভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাবে, আরব দেশগুলো ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আব্রাহাম চুক্তির মতো পথে হেঁটেছে একটা সময়। মিশর ও জর্ডানের মতো দেশ ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে গেছে, কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—চুক্তির আবর্তে কি সংকটের উত্তরণ ঘটেছে?
এবারের হামাস-ইসরাইল যুদ্ধের পরও বিভিন্ন অঞ্চলে পরিস্থিতি ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আম্মানে ইসরাইলি দূতাবাসে হামলা চালানোর চেষ্টা করলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে জর্ডান পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বৈরুতে। লেবাননে মার্কিন দূতাবাসে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠতে দেখা গেছে, মিশরীয়দেরও। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে মিশরের জনগণ। বিক্ষোভ চলেছে মরক্কোর মাটিতেও। হাজার হাজার মরক্কান স্লোগান দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। রাবাতে ইসরাইলি লিয়াজোঁ অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘটনার রেশ বয়ে গেছে বাহরাইনেও—ইসরাইলি দূতাবাসের দিকে মিছিল করতে করতে এগিয়ে যাওয়া প্রতিবাদী জনতা পুলিশের সঙ্গে বাহাসে লিপ্ত হয়। সুদান যদি নিজের যুদ্ধের কারণে ব্যস্ত না থাকত, তাহলে বসে থাকত না সে দেশের জনগণও। ২০২০ সালে ইসরাইলের বিপক্ষে যেভাবে ফুঁসে উঠেছিল খার্তুম, এবারও তার বিপরীত কিছু ঘটত না।
ওপরের চিত্র থেকে কী বোঝা যায়? এসব কীসের ইঙ্গিত? আসলেই, মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে ছাইচাপা আগুন বারবার বের হয়ে আসতে চায় ক্ষীপ্রগতিতে। এটা কেবল কথার কথা নয়। ফিলিস্তিন ইস্যুর বাস্তবতাই এমন—জীবিত হয়, জ্বলে ওঠে মারা যায় এবং আবার জেগে ওঠে।
প্রায় এক দশক আগের মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে আজকের মধ্যপ্রাচ্যের বহু জায়গায় ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। কয়েকটা যুদ্ধের পর মনে হয়েছিল, আরব বিশ্ব বদলে গেছে আমূল, কিন্তু বাস্তবচিত্র বলে অন্য কথা। বর্তমানে অস্থির সময় পার করছে মিশর। অর্থনৈতিক সংকটের কবলে পড়ে নাভিশ্বাস উঠছে কায়রোর। জর্ডানের অবস্থাও তাই। সৌদি আরবের অবস্থা যে রঙিন, এমন কথা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। গত এক দশকে বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক হয়ে উঠেছে কাতার, যার ফলে নানা হিসাবনিকাশের মধ্য দিয়ে পথ চলতে হচ্ছে দোহাকেও।
মধ্যপ্রাচ্যের ধনী ও আরব রাষ্ট্রগুলো যখন নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে ইসরাইলি ভূখণ্ডে হামলা করে বসল হামাস। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য আবারও পড়ে গেল সংকটের মাঝ সাগরে। আমরা জানি, সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ইরান ও সৌদি আরবকে এক টেবিলে দেখা গিয়েছিল চীনের দ্যূতিয়ালিতে। এসব উদ্যোগ মধ্যপ্রাচ্যের জন্য সুদিন বয়ে আনত কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ, কিন্তু ইসরাইল-হামাস সংঘাত সবকিছুকে ম্লান করে দিয়েছে। সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল!
আরব দেশগুলো ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে যাবে না। আবার ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে তারা একেবারে বসেও নেই। হয়তোবা ইসরাইলকে দুর্বল হিসেবে দেখাটাই এসব দেশের প্রত্যাশা। বস্তুত মধ্যপ্রাচ্য এমন এক অঞ্চল, যেখানকার মাটিতে আন্দোলন-সংগ্রামের বীজ পোঁতা হয়েছে বহুকাল আগেই। সাময়িক সময়ের জন্য পরিস্থিতি শান্ত থাকতে দেখে যদি কখনো এ রকমটা মনে হয়, সংকট কেটে গেছে, তাহলে তা হবে ভুল চিন্তা। এই অঞ্চলের জনগণকে শক্ত করে চেপে ধরুন, তারা ঠিকই বলবে—এটা সেই মধ্যপ্রাচ্য, যেখানে বহু সমস্যা রয়ে গেছে এখনো।
https://www.youtube.com/watch?v=R7pYw348nHs
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post