মাগুরা জেলার আলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হাসান (ছদ্মনাম) গত আগস্টে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে সুরিয়া হারমোনি নামের একটি কম্পানিতে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে যোগ দেন। কম্পানির প্রতিশ্রুতি ছিল, প্রতি মাসে তিনি স্থানীয় মুদ্রায় এক হাজার ৫০০ রিঙ্গিত আয় করবেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। কম্পানির লোকজন তাকে আটকে রেখে ছয় হাজার রিঙ্গিত দাবি করে।
শুধু হাসান নন, তাঁর মতো আরো ৪০০ বাংলাদেশি শ্রমিক এই কম্পানির লোকদের হাতে এভাবে আটকা পড়ে আছেন বলে জানান এই বাংলাদেশি কর্মী।
মালয়েশিয়া থেকে মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে হাসান জানান, মালয়েশিয়া আসার পর তাঁদের কাছ থেকে কম্পানির লোকজন পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে গেছে। এরপর তাঁদের বলা হয়, পাসপোর্ট-ভিসা ফেরত নিতে হলে ছয় হাজার রিঙ্গিত দিতে হবে। এর আগেও এখানে আরো অনেকে এভাবে আটকা পড়েন বলে জানান হাসান।
অনেকে তাঁদের চাহিদা মিটিয়ে পাসপোর্ট-ভিসা নিতে পেরেছেন। অনেকে আবার সুযোগ বুঝে পালিয়ে যান।
হাসান বলেন, ‘জমি বন্ধক রেখে, এনজিও থেকে লোন নিয়ে, গরু বিক্রি করে ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে মালয়েশিয়া আসার টাকা জোগাড় করেছি। এখন আর বাড়ি থেকে টাকা আনার মতো অবস্থা নেই।
কী করব, কার কাছে যাব, কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। একেবারে অন্ধকারে পড়ে আছি। তাদের টাকা না দিতে পারলে পাসপোর্ট-ভিসাও পাব না।
অবৈধ হয়ে যাব।’
হাসানসহ ১৪ জনের একটি দল গত ২৫ আগস্ট রিক্রুটিং এজেন্সি এশিয়াটিক ট্যালেন্টসের মাধ্যমে ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া যায়।
সে দেশে পৌঁছানো পর্যন্ত তাঁরা জানতেন যে সেখানে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে গেছেন। কিন্তু মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর তাঁরা টের পান পুরো জিনিসটিই ধোঁকা।
দলের আরেকজন হলেন সিয়াম হোসেন (ছদ্মনাম)। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানায় তাঁর বাড়ি।গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করব বলে আমাদের দুই দিনের ট্রেনিং দেওয়া হয়। এখন শুনি এই কম্পানির নির্মাণবিষয়ক কোনো কাজই নেই। এরা লোকদের এনে আটকে রেখে টাকা আদায় করে। আমাদেরও আটকে রেখেছে। কখনো এক বেলা খাবার দেয়, কখনো তা-ও দেয় না। অনেক বড় বিপদের মধ্যে আমাদের জীবন কাটছে।’
কর্মীরা মাঝে-মধ্যে নির্যাতনের শিকার হন বলে জানান সিয়াম হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখানে এক ফ্লোরের মানুষের সঙ্গে আরেক ফ্লোরের লোকজনকে কথা বলতে দেয় না। কথা বলতে গেলে তারা মারধর করে। নানা রকম হুমকি-ধমকি দেয়। আমাদের কেউ দেশে যোগাযোগ করলে বা এই বিপদের কথা জানালে ওরা যদি টের পায়, তাহলে রুমের ভেতর আটকে মারধর করে। গরম পানি গায়ে ঢেলে দেয়। গতকালও দুজনকে রুমে আটকে মারধর করেছে। ভিসা-পাসপোর্ট না দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।’
হাসান ও সিয়াম জানান, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের চৌকিত এলাকার পুরনো সংসদ ভবনের সামনের একটি হোটেলে তাঁদের আটকে রাখা হয়েছে। হোটেলটি ওই দেশে সাদ্দাম হোটেল নামে পরিচিত। এই কম্পানিতে কাজ করতে যারা আসে, তাদের এখানে এনে আটকে রাখা হয়।
হাসান থেকে পলাশ (ছদ্মনাম) নামে আটকে পড়া আরেকজনের খোঁজ মেলে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের বাসিন্দা তিনি। পলাশ চলতি বছরের ২৬ মে রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সি এশিয়াটিক ট্যালেন্টসের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যান।
মোবাইল ফোনে গণমাধ্যমকে পলাশ বলেন, ‘আমি চার লাখ ৬৫ হাজার টাকা খরচ করে এসেছি। আমাকেও নির্মাণ শ্রমিকের কাজ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এখানে এসে আটকা পড়ি। আমারও পাসপোর্ট-ভিসা ওদের কাছে। ছয় হাজার রিঙ্গিত না দিলে ফেরত পাব না। আমার ফ্লোরের কয়েকজন জুলাই মাসে টাকা পরিশোধ করে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে বের হয়ে গেছে। আমার এখনো টাকা জোগাড় হয়নি, তাই দিতেও পারছি না। জানি না কবে টাকা দিয়ে এখান থেকে মুক্তি পাব।’
মালয়েশিয়া গিয়ে আটকে পড়া কর্মীদের রিক্রুটিং এজেন্সি এশিয়াটিক ট্যালেন্টসের ম্যানেজিং পার্টনার মোহাম্মদ সাহিনুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলার জন্য একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ বিষয় এখন পর্যন্ত আমরা কিছু জানি না। আপনার কাছ থেকে প্রথম জানতে পারলাম। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নেব।’
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের শ্রম উইংয়ের কনসুলার ও প্রথম সচিবের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post