সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তেজগাঁও বিমানবন্দরের মধ্যসত্তর দশকের একাধিক ছবি দেখে মনে পড়ে গেল ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস, অর্থাৎ ঠিক ৪৬ বছর আগে ঘটে যাওয়া জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাটি। পড়তাম শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমাদের বিদ্যালয়ের পূর্বদিকে ছিল তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে। ‘আমাদের বিদ্যালয়’ রচনা পরীক্ষায় এলে লিখতাম, ‘আমাদের বিদ্যালয়টি ঢাকার তেজগাঁও থানার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত। বিদ্যালয়টি লাল সিরামিক ইটে তৈরি, এল টাইপের, বিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে তেজগাঁও বিমানবন্দর অবস্থিত। বিমানবন্দরটিতে প্রতিদিন বহু দেশি-বিদেশি বিমান ওঠানামা করে…।’
আমার বড় মামা হাশেম খান ছিলেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একজন সৈনিক। তিনি ছিলেন মেকানিক্যাল কোরের এয়ার ক্রাফট টেকনিশিয়ান। তেজগাঁও বিমানবন্দরসংলগ্ন বাশার ঘাঁটি ছিল মামার কর্মস্থল। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হেলিকপটার, ফাইটার, এয়ারক্রাফটগুলো তেজগাঁও বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে রাখা হতো। মামা একদিন তেজগাঁও বিমানবন্দর নিয়ে গিয়েছিলেন। সময়টা ১৯৭৬-৭৭ সালের কোনো এক সন্ধ্যা। যতদূর মনে পড়ে দেশি-বিদেশি অনেক মানুষের বিচরণ ছিল সেখানে। অবাক হয়ে এদিক-ওদিক দেখছিলাম। তেজগাঁও বিমানবন্দরের ভেতরে বিশালকায় এক হলরুম। হলরুমের মাঝখানে ছিল একটি বড় আকারের শোকেস। ঝলমলে আলোতে স্বচ্ছ কাচঘেরা শোকেসটি ছিল ভারি দৃষ্টিনন্দন। আমাদের বিদ্যালয় থেকে যাত্রীদের বিমানে ওঠানামা দেখা যেত। দেশি-বিদেশি ছোট মাঝারি কিংবা বড় বিমানগুলো যেন হাত দিয়ে ধরা যাবে, সে সময় এতটাই কাছে মনে হতো।
১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৭-৩৮ বছর তেজগাঁও বিমানবন্দরটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান বিমানবন্দর। ১৯৮০ সালে কুর্মিটোলায় বর্তমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে পরিত্যক্ত হয় তেজগাঁও বিমানবন্দরটি। এই বিমানবন্দরের মূল ভবন পরিচিতি পায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অফিস হিসাবে। বিমানবন্দরের রানওয়েকে বানানো হয় প্যারেড স্কোয়ার। যদিও বর্তমানে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের দপ্তরটিও এখন আর এই ভবনে নেই। সরকারিভাবে তেজগাঁও বিমানবন্দরটি এখনো স্বীকৃত, কিছুসংখ্যক হেলিকপটার ওঠানামার মধ্যেই এর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ।
দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে তেজগাঁও বিমানবন্দরে বাণিজ্যিক বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ বন্ধ। তাই এটি যে একসময় বাংলাদেশের প্রধান বিমানবন্দর ছিল, সেটি চল্লিশের নিচের প্রজন্ম জানেই না। অথচ ১৯৭৭ সালে এই সেপ্টেম্বর মাসেই বিমানবন্দরটিকে বিশ্ববাসী চিনেছিল একটি বিশেষ কারণে। সে বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর জাপানি এয়ারলাইনসের একটি বিমান ছিনতাইকারীরা ছিনতাই করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নিয়ে এসেছিল। ভারতের তত্কালীন বোম্বে বিমানবন্দর থেকে জাপানি এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৪৭২-এর ডিসি ৮-এ ১৪ জন ক্রু আর ১৩৭ জন যাত্রীসমেত বিমানটি আকাশে ওড়ার ১২ মিনিটের মাথায় ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে। সকাল ১০টায় বিমানটি বাংলাদেশের আকাশসীমায় পৌঁছায়, আর ৩০ মিনিট পর ছিনতাইকৃত বিমানটি ঢাকার আকাশে পৌঁছে বাংলাদেশ বিমানবন্দর অথরিটির কাছে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণের অনুমতি চায়। স্বাভাবিকভাবেই বিমানবন্দর অথরিটি বিমানটিকে অবতরণের অনুমতি দেয়নি। ঘণ্টাখানেক বিমানটি বাংলাদেশের আকাশে চক্কর দেওয়ার পর বেলা সাড়ে ১১টায় নিয়ন্ত্রণকক্ষের অনুমতি ছাড়াই তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়েতে নেমে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার বিমানবন্দরে যে কোনো প্রকার উড্ডয়ন ও অবতরণ বন্ধ ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বিমানটিকে ঘিরে ধরে।
তখন বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দু হয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার এই তেজগাঁও বিমানবন্দরটি। দেখতাম রেডিওতে বিমান ছিনতাইয়ের খবর শোনার জন্য বড়রা উদ্গ্রীব হয়ে থাকতেন। ‘রেড আর্মি’ নামে একটি সশস্ত্র গ্রুপ জাপানি বিমানটি ছিনতাই করে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল। ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর টানা ছয় দিন ধরে চলে ত্রিমুখী দেনদরবার। একদিকে ছিনতাইকারীদের ‘রেড আর্মি’ অন্যদিকে জাপান সরকার আর মধ্যস্থতাকারী বাংলাদেশ সরকার। উগ্রপন্থি ছিনতাইকারী ‘রেড আর্মি’র দাবি ছিল জাপানের কারাগারে আটক তাদের ৯ সদস্যের মুক্তি এবং ৬০ লাখ মার্কিন ডলার।
জিম্মি যাত্রীদের রক্ষা করতে তত্কালীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন। সমস্যা সমাধান করতে ঢাকায় এসেছিলেন সেই সময়কার জাপানের ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির উচ্চপর্যায়ের একটি দল। জাপানের তত্কালীন পরিবহন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন হাজিমে ইশিই। তিনি জাপানি বিমান ছিনতাই নিয়ে ‘ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাই ১৯৭৭’ নামে স্মৃতিচারণমূলক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার বইয়ে জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় বাংলাদেশের সাহসী ও জোরালো ভূমিকার কথা রয়েছে। তিনি লিখেছেন ‘বাংলাদেশ সরকারের নীতি ছিল রক্তপাত এড়িয়ে নিজেদের হাতে জিম্মিদের জীবিত উদ্ধার করা। কারণ তত্কালীন জাপানি সরকার বাংলাদেশ সরকারকে জাপান থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র পুলিশ কমান্ডো বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, যা তত্কালীন বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেনি।’
শ্বাসরুদ্ধকর অনেক নাটকীয় ঘটনার পর ১৯৭৭ সালের ৫ অক্টোবর সেই ছিনতাই ঘটনার সফল পরিসমাপ্তি হয়েছিল।
তেজগাঁও বিমানবন্দরের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়ার সময় নস্টালজিক হই, সক্রিয় হয়ে ওঠে বিমানবন্দরটি, যেখানে সাঁইসাঁই আওয়াজে দেশি-বিদেশি বিমান ওঠানামা করছে আর কানে হাত দিয়ে আমরা তা উপলব্ধি করছি।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post