দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে এখনই বহুমুখী ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। কেননা বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে গেছে, বেড়ে গেছে খরচ। এখন আয়ের চেয়ে খরচ হচ্ছে বেশি। ফলে দুই বছর ধরে রিজার্ভের ওপর হাত পড়েছে। রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ মেটাতে হচ্ছে। প্রকৃত হিসাবে আয় থেকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে যোগ হচ্ছে না। ফলে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। গত দুই বছরে রিজার্ভ ১ হাজার ৯২০ কোটি ডলার কমে এখন নিট দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৪৮ কোটি ডলারে।
এদিকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) জুনে নিট রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ২০ লাখ ডলার রাখার কথা বলেছিল। যা দিয়ে ২ দশমিক ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। রিজার্ভ এখন তার চেয়েও ২৯৮ কোটি ডলার কম।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। তবে কোনো দেশ খাদ্য আমদানি করলে রিজার্ভ আরও বেশি রাখতে হয়। বৈশ্বিক বা দেশীয় সংকট দেখা দিলে আরও বেশি রিজার্ভ রাখতে হয়। এ হিসাবে বর্তমানে কমপক্ষে ৫ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকা দরকার বলে অনেকেই মনে করেন। কিন্তু তা আছে তার চেয়ে অনেক কম।
সূত্র জানায়, দেশের অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে। আমদানির চাহিদা বেড়েছে। ফলে আমদানির পরিমাণও বেড়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ডলার সাশ্রয় করতে আমদানি কমানো হয়েছে। ফলে আমদানি খাতে ডলার খরচ কমেছে। তবে আগের বৈদেশিক ঋণ, করোনা ও বৈশ্বিক মন্দায় মেয়াদ বাড়ানো ঋণ এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া কোম্পানির মুনাফা, রয়্যালটি, বিদেশি কর্মীদের রেমিট্যান্স পাঠানো, চিকিৎসা, শিক্ষা ও ভ্রমণ খাতে ডলার খরচ করতে হচ্ছে। এসব কারণে আমদানি কমলেও বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমেনি। বরং আরও বেড়েছে।
এদিকে বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে কত মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে তা নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, প্রায় চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। রিজার্ভে ডলার যোগ হওয়া ও খরচ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এতে কোনো ঝুঁকি দেখছেন না তারা। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, রিজার্ভ নিয়ে ঝুঁকি নেই। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। কারণ বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আমদানি কমানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, স্বাভাবিক অবস্থায় দেশে প্রতিমাসে প্রায় ৮০০ থেকে ৭০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করতে হয়। এ হিসাবে তিন মাসের আমদানিতে লাগবে ২ হাজার ১০০ কোটি থেকে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। বর্তমানে রিজার্ভ আছে ২ হাজার ১৪৮ কোটি ডলার। এ রিজার্ভ দিয়ে স্বাভাবিক আমদানি তিন মাস চলবে। বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় আমদানি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি ডলার। এ হিসাবে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের জন্য প্রয়োজন ১ হাজার ৫০০ কোটি থেকে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। এ রিজার্ভ নিয়ে নিয়ন্ত্রিত আমদানি তিন মাসের বেশি চলবে। তবে খাদ্যসহ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য ওই রিজার্ভ যথেষ্ট নয় বলে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। এদিকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকও বলেছে, রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়া যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রিজার্ভ বেশি থাকলে বিদেশিরা আস্থা পায়, বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। রিজার্ভ কম থাকলে বিদেশিদের আস্থায় চিড় ধরে। ডলারের দাম অস্থির হয়ে যায়। বর্তমানে ডলারের বাজারের অস্থিরতা দিয়েই প্রমাণ হয় এ রিজার্ভ নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়। রিজার্ভ বাড়াতে হবে, ডলারের দাম মুদ্রাবাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত দেড় বছর ধরে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এতে আমদানি কমে গেছে। আমদানিনির্ভরসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বিশেষ করে আমদানিনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। ডলার সাশ্রয় করতে যদি আমদানি আরও নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে এ খাতে আরও ধস নামবে। তখন অর্থনীতি আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদিকে ডলার সংকটে আমদানি আরও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ কিছু পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে রিজার্ভে আরও চাপ বাড়বে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কারণেও রিজার্ভে চাপ বাড়ছে। এছাড়া বড় ঝুঁকি হচ্ছে আগে প্রতিমাসে রিজার্ভে কিছু ডলার যোগ হয়ে তা বাড়ত। এখন বাড়ছে তো না-ই, উলটো কমে যাচ্ছে। এসব কারণে এখন রিজার্ভে বহুমুখী ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। ওই সময়ে গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলার ও নিট ছিল ৪ হাজার ৬৮ কোটি ডলার। বর্তমানে গ্রস রিজার্ভ ২ হাজার ৭৬১ কোটি ও নিট ২ হাজার ১৪৮ কোটি ডলার। ওই সময়ে রিজার্ভ গ্রস রিজার্ভ কমেছে ২ হাজার ৪৫ কোটি ডলার ও নিট কমেছে ১ হাজার ৯২০ কোটি ডলার। অর্থাৎ ২০২১ সালের আগস্টের পর রিজার্ভ বাড়েনি। বরং ধারাবাহিকভাবে কমেই যাচ্ছে। এটি কোথায় গিয়ে নিম্নমুখী প্রবণতা রোধ হবে সেটি এখনো কেউ বলছে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব এখনো বাংলাদেশে আসছে। ফলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়ছে না। এদিকে বৈশ্বিক ঋণ শোধও বাড়ছে। এতে রিজার্ভে চাপ বাড়ছে।
গত আগস্টে দেশে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স মিলে আয় হয়েছে ৬৪০ কোটি ডলার। জুলাইয়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার। আগের ঋণ শোধ করতে হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার। মোট খরচ হয়েছে ৭৫০ কোটি ডলার। সব মিলে ঘাটতি হয়েছে ১১০ কোটি ডলার। এটি রিজার্ভ থেকে দেওয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ ১৩১ কোটি ডলার শোধ করা হয়েছে। এতেও রিজার্ভ কমেছে।
বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত আমদানি ব্যয় রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় দিয়ে মেটানো যাচ্ছে। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কারণে রিজার্ভে চাপ পড়ছে। এভাবে রিজার্ভ কমতে থাকলে তা বড় দুশ্চিন্তার কারণ বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
চলতি বছরের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণের আরও ৮০০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। এ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়েই রিজার্ভেও হাত পড়ছে। এদিকে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অনুদান দুটোই কমে গেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সব খাতেই নেতিবাচক অবস্থা। আগামীতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। চলতি বছরের মতো আগামী বছরও ডলার সংকট থাকতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বৈদেশিক অনুদান এসেছিল ৮৪৮ কোটি ডলার, আগের বছরের তুলনায় বেড়েছিল ৫২ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছে ৭৫১ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় সাড়ে ১১ শতাংশ কম। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই গত অর্থবছরে এসেছে ১৬১ কোটি ডলার, আগের অর্থবছরে এসেছিল ১৮৩ কোটি ডলার। এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমেছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post