যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৩৭ কোটি ২ লাখ ডলার। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার। সে অনুযায়ী এক বছরের ব্যবধানে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৪৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র ১৭ কোটি ২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা একক মাসের হিসাব অনুসারে তিন বছরে সর্বনিম্ন। রেমিট্যান্স প্রবাহের দিক থেকে শীর্ষ তালিকার দ্বিতীয় স্থানটি টানা তিন বছর দখলে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু জুলাই ও আগস্টে এসে তা চতুর্থ স্থানে নেমে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে হঠাৎ রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় পতনের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানাতে পারেননি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, তিন বছর আগে হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে দেখা যায়। দেশটি থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছিল, তার কোনো যৌক্তিকতা পাওয়া যায়নি। এখন আবার রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় পতন হয়েছে। হঠাৎ করে তা অর্ধেকের নিচে নেমে আসারও কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তবে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও ঢাকার একাধিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে প্রভাবশালীদের একটি অংশ দেশটিতে পাচার করা অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছিলেন। এর একটি অংশ রেমিট্যান্স হিসেবে বাংলাদেশে এসেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এ কারণে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার পথও অনেকটাই সংকুচিত হয়ে এসেছে, যা দৃশ্যমান হচ্ছে রেমিট্যান্সে বড় পতনের মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশী মকবুল আহমেদ জানান, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে আয়ের উৎস সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। পরিমাণ বেশি হলে আয়ের নথিপত্রও চাওয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রকৃত রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসীরাও দেশে টাকা পাঠাতে নিরুৎসাহিত হবেন। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার সঙ্গে নতুন মার্কিন ভিসানীতির দৃশ্যত কোনো যোগসূত্র সামনে না এলেও প্রবাসীদের দেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের বিষয়টিকে অস্বাভাবিক মনে করছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষ। ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের টানাপড়েন এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০ সালের শুরুর দিক থেকে হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসে ৩৪৬ কোটি ১৬ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরেও ৩৪৩ কোটি ৮৪ লাখ ডলার প্রবাসী আয় আসে দেশটি থেকে। আর গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩৫২ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৬ কোটি ৩৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে, যা দেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকেও প্রায় দেড় কোটি ডলার বেশি। আর গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেকর্ড ৪২ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। ডিসেম্বরের পর থেকেই দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে শুরু করে। সর্বশেষ আগস্টে যা নেমে এসেছে মাত্র ১৭ কোটি ২ লাখ ডলারে।
মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দেশের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হলে সেটির প্রভাব ওই দেশের সব প্রতিষ্ঠানের ওপরই পড়ে বলে জানালেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন সরকার একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এসব সিদ্ধান্তের প্রভাবে দেশটির সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীদের বিষয়ে সতর্ক থাকবে। এখন ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়, সেটিও আশ্চর্যের বিষয় হবে না।’
এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সাধারণ বাংলাদেশীরা খুব অল্প পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠান। এ ধরনের অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও বড় অংকের অর্থ লেনদেন করতে গেলে সেটির বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হয়। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যদি আরো কঠোরতা আরোপ করা হয়, সেটি ভিন্ন কথা। প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে, এমন শঙ্কা থেকেও বাংলাদেশীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো থেকে বিরত থাকতে পারেন।’
যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর (ইউএসসিবি) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের শেষে সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ ৬৪ হাজার। এর মধ্যে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজারের কিছু বেশির। দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশীদের খানাপিছু গড় বার্ষিক আয় ৬৮ হাজার ডলারের কিছু কম। অন্যদিকে ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিস্টিকসের (ইউএসবিএলএস) হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২১ সালে খানাপিছু গড় ব্যয় ছিল প্রায় ৬৭ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশী খানাগুলোর উপার্জনকারীরা বছরজুড়ে আয় করেছেন দেশটির গড় খানাপিছু ব্যয়ের চেয়ে সামান্য বেশি। এ হিসাব আমলে নিলে বাংলাদেশী পরিবারগুলোর উদ্বৃত্ত বা সঞ্চয়ও খুব বেশি হওয়ার কথা না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এ বাংলাদেশীরাই এখন দেশের রেমিট্যান্সের বড় উৎস।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসে ৩৫২ কোটি ২০ লাখ ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যেক বাংলাদেশী প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২ হাজার ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। যদিও সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের বক্তব্য হলো প্রতি মাসে জীবনযাপনের ব্যয় বহন করে দেশে ২ হাজার ডলার পাঠানো বেশির ভাগ প্রবাসীর পক্ষেই প্রায় অসম্ভব।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post