বাংলাদেশ থেকে গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২ লাখ ২২ হাজার ৮১৫ কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন। সে হিসেবে প্রতি মাসে গেছেন প্রায় ২৫ হাজার কর্মী। যদিও দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্সে বড় অংকের এ জনশক্তি রফতানির প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। মূলত হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠানোর কারণে মালয়েশিয়া থেকে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা পালনের দাবিও জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যান ৫৪ কর্মী। এ সময়ে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসে ২৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। একই বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশটিতে ৫ হাজার ২৭৩ কর্মী যাওয়ার বিপরীতে রেমিট্যান্স আসে ৩২ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে কর্মী যান ৪৪ হাজার ৭২৯ জন এবং এ সময়ে রেমিট্যান্স আসে ২১ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে মালয়েশিয়ায় ৮২ হাজার ৮৯৩ কর্মী রফতানির বিপরীতে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২৮ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। সর্বশেষ এ বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ৯৫ হাজার ১৯৩ কর্মী গেছেন এবং এ সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২৯ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির সংখ্যা ও রেমিট্যান্স আহরণের চিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় এর পরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে জনশক্তি রফতানি সাড়ে আট গুণ বাড়লেও এ সময়ে রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ৩৩ শতাংশ কমে। এর পরের প্রান্তিকগুলোয়ও দেশটিতে যে হারে জনশক্তি রফতানি বেড়েছে সে হারে রেমিট্যান্স বাড়েনি।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানকার পাম বাগানে অনেক বাংলাদেশী কাজ করেন। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা পাম বাগানে কর্মরত এসব শ্রমিকের মধ্যে কাউকে কাউকে তাদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়। এসব এজেন্ট শ্রমিকদের কাছ থেকে বেতনের অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশে থাকা চক্রের সদস্যের মাধ্যমে শ্রমিকদের পরিবারের কাছে টাকা পাঠিয়ে দেয়। অন্যদিকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায় দেশটিতে সেকেন্ড হোম প্রকল্পসহ অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের কাছে। এভাবেই সেখানে হুন্ডির একটি বিশাল শৃঙ্খল গড়ে উঠেছে।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদেশে যাওয়া প্রবাসীদের প্রায় সবাই চাকরি পেয়েই সেখানে যান। ২ শতাংশের মতো হয়তো চাকরি ছাড়া যেতে পারেন কিংবা যাওয়ার পর চাকরিহীন হয়ে যান। বিদেশ থেকে কীভাবে দেশে রেমিট্যান্স আসবে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নজরদারির দরকার ছিল। কিন্তু তারা কি সেটি করেছে? করেনি। মালয়েশিয়ায় যারা হুন্ডির ব্যবসা করে তারা কারখানায় গিয়ে সেখানকার কর্মীদের হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করে। এ চক্রের সহায়তায় প্রবাসী শ্রমিকরা সহজে ও কম ঝামেলায় দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন, অন্যদিকে টাকাও বেশি পাচ্ছেন। ফলে তারা হুন্ডিকেই দেশে টাকা পাঠানোর চ্যানেল হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। অন্যদিকে বিদেশে যাওয়া প্রবাসীদের অনেকেই শিক্ষিত নন ও অদক্ষ। তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সব প্রক্রিয়া অনেক সময় বুঝে উঠতে পারেন না। এক্ষেত্রে তারা সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গেলে তেমন কোনো সহায়তাও পান না। এ কারণেও প্রবাসীরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’
সার্বিকভাবে দেশ থেকে বিদেশে যাওয়া জনশক্তির সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সে হারে দেশে রেমিট্যান্স বাড়ছে না। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৯৩১ কর্মী বিদেশে যান। এর আগের অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৯১০ জন। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৭ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। এর আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ ডলার।
দেশে বিনিময় হারে পার্থক্যের কারণে বেশি টাকা পাওয়ার আশায় হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের অর্থ আসা বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এমনকি সরকারের প্রণোদনার চেয়েও হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠালে বেশি লাভ পান প্রবাসীরা। এক্ষেত্রে বিনিময় হারকে একীভূত ও বাস্তবসম্মত করতে না পারার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায় রয়েছে বলে মনে করছেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জানুয়ারি শেষে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৬ টাকা। চলতি বছরের জুলাই শেষে এ হার দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকায়। সর্বশেষ আন্তঃব্যাংক ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। যেখানে কার্ব মার্কেটে ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ১১৭ টাকা ৬০ পয়সা।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পরিসংখ্যান বলছে গত অর্থবছরে বিদেশে জনশক্তি রফতানির সংখ্যা বেড়েছে। গড়ে প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ করে জনশক্তি বিদেশে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়ায় বেশ বড় সংখ্যক প্রবাসী গেছেন। জনশক্তি রফতানি বাড়লেও সে অনুপাতে রেমিট্যান্স না আসার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে যারা বিদেশে যাচ্ছেন ভিসা বাণিজ্যের কারণে তাদের বিদেশী মুদ্রায় একটি ব্যয় রয়েছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, এটি কমপক্ষে দেড় হাজার থেকে ৩ হাজার ডলার হয়ে থাকে। ফলে যে রেমিট্যান্স আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আসত সেটি অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে গত বছর যারা বিদেশে গেছেন তাদের পাঠানো আয়ের কারণে এ বছর তো অন্তত রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রভাব দেখা যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে আমাদের মুদ্রাবাজারের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বাজারদরে পার্থক্য। আনুষ্ঠানিক মাধ্যমের তুলনায় হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলারের দাম বেশি পাওয়ার কারণে প্রবাসীরা এ মাধ্যমেই দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন।’
মালয়েশিয়ান বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, দেশটির আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো চলতি বছর বেশ কয়েকবার হুন্ডি ও অর্থ পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে গত এপ্রিলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করার অভিযোগে ১২ বাংলাদেশীসহ ২৯ জন অভিবাসীকে গ্রেফতার করে দেশটির অভিবাসন বিভাগ। কুয়ালালামপুর ও সেলাঙ্গরে বিশেষ অভিযান চালিয়ে এসব হুন্ডি কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়। অভিবাসন মহাপরিচালক দাতুক রুসলিন জুসোহ সে সময় জানিয়েছিলেন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশী তিনজন অভিবাসী লাইসেন্সবিহীন হুন্ডি ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে এমন খবর পেয়ে ১০টি স্থানে অভিযান চালানো হয়। হুন্ডি কারবারিরা কর্তৃপক্ষের নজর ফাঁকি দিতে রেস্তোরাঁ, মুদি দোকান, কসমেটিকস আউটলেট ও ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকানি পরিচয়ের আড়ালে প্রবাসীদের দেশে অর্থ পাঠানোর কাজে সক্রিয় ছিল। অভিযানে নগদ হুন্ডির জন্য রাখা ৩ লাখ ৫২৭ রিঙ্গিত, মোবাইল ফোন, রেকর্ড বই এবং বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার রেমিট্যান্সের নথিপত্র জব্দ করা হয়।
সর্বশেষ গত জুলাইয়েও দেশটিতে অর্থ পাচারবিরোধী একটি অভিযান চালানো হয়। ওই অভিযানে ৩ কোটি ৮০ লাখ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, ২০০ কেজি স্বর্ণ এবং ১৭টি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়। মালয়েশিয়ার দুর্নীতিবিরোধী কমিশনের (এমএসিসি) নেতৃত্বে ছয়টি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি টাস্কফোর্স অভিযানটি চালায়। এ অভিযানে মালিক গ্রুপ অব কোম্পানিজের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান আবদুল মালিক দস্তগীরকে আটক করা হয়। অর্থ পাচার, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন ও বেআইনি কর্মকাণ্ডবিরোধী আইনে তাকে আটক করা হয়। যদিও তিনি পরে আদালতের আদেশে জামিন পান। আবদুল মালিক দস্তগীর মালয়েশিয়ায় ‘দাতো মালিক’ হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। দাতো মালিক মালয়েশিয়ায় কর্মী নেয়ার ক্ষেত্রে কথিত সিন্ডিকেটের হোতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান নাগরিক দাতো শ্রী আমিনের প্রধান সহযোগী। তার মাধ্যমেই দাতো শ্রী আমিন মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বিভিন্ন কোম্পানির অনুমোদন নিয়েছে। দাতো শ্রী আমিনের কোম্পানি বেস্টিনেট ও মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠান কেএসএম কর্মী পাঠানোর মিডিয়া হিসেবে কাজ করেছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সম্প্রতি মালয়েশিয়া থেকে দেশে রেমিট্যান্স আনার বিষয়ে প্রবাসীদের উৎসাহিত করতে দেশটিতে সফর করেন। সেখানে ব্যাংকটির এক্সচেঞ্জ হাউজ রয়েছে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি সেখানে গিয়ে প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে তাদের অনেকেই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাদেরকে আমি অপ্রাতিষ্ঠানিক এ চ্যানেলের কুফল সম্পর্কে সচেতন করে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছি।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post