আজ ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এই দিনে তিনি সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। এর আগে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে দীর্ঘ নয় মাস কারাভোগের পর বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন। পরে তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন যান এবং দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন।
বঙ্গবন্ধু প্রথমে কেন লন্ডন গিয়েছিলেন, তা নিয়ে সংশ্লিষ্টজনরা নানা মত দিয়েছেন। বিষয়টি সেভাবে খুব একটা আলোচনায় না আসলেও এটা কম-বেশি সবারই জানা যে, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান থেকে সরাসরি ঢাকা কিংবা ভারতে পাঠাতে চায়নি পাকিস্তান সরকার। এর পরিবর্তে পাকিস্তানের শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে তেহরান কিংবা ইস্তাম্বুলে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনড়। তাই তাকে সরাসরি বাংলাদেশে না পাঠিয়ে তৃতীয় অন্য কোনো দেশ বেছে নেয়ার কথা বলা হয়। বঙ্গবন্ধু তখন বেছে নিয়েছিলেন লন্ডনকে।
এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ মোজাম্মেল আলী। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ব্রিটেনে বসবাস করছেন। বঙ্গবন্ধুর লন্ডন সফরের সময়ও সেখানেই ছিলেন। ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া সৈয়দ মোজাম্মেল বলেন, ‘মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকা যেতে চান তখন কর্তৃপক্ষ (পাকিস্তান সরকার) জানায়, সরাসরি তাকে ঢাকা পাঠানো যাবে না; ভায়া হয়ে যেতে হবে। তারা বঙ্গবন্ধুকে ইরানে পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যদি সরাসরি ঢাকায় না পাঠানো যায় তাহলে ইংল্যান্ড হয়ে যাবেন। এরপর লন্ডনে পাঠানো হয় তাকে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শনিবার রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে লন্ডনে আসেন বঙ্গবন্ধু।’
সৈয়দ মোজাম্মেল আলীর কথার প্রতিধ্বনি করেছেন সে সময়ে লন্ডনে উপস্থিত ভারতীয় সাংবাদিক সুন্দর কাবাদি। তিনি বলেছেন, ‘বন্দি হিসেবে তার (বঙ্গবন্ধু) ঢাকায় যাওয়ার বদলে লন্ডনে না এসে উপায় ছিল না। তিনি ঢাকাতেই যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভুট্টো তাতে রাজি হননি। তাকে ভারতে যেতে দিতেও ভুট্টো নারাজ। ভুট্টো শেখ মুজিবকে তেহরান অথবা ইস্তাম্বুলে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব ওই দুই জায়গার কোথাও যেতে রাজি হননি। ভুট্টোকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তেহরান বা ইস্তাম্বুল যাওয়ার বদলে তিনি পাকিস্তানের কারাগারেই থাকবেন এবং এ সিদ্ধান্ত থেকে এতটুকু নড়বেন না। যদিও এরপরই বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠাতে রাজি হন ভুট্টো। আর এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে আসা।’
বঙ্গবন্ধু লন্ডনে ছিলেন মাত্র কয়েক ঘণ্টা। আপাতদৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর লন্ডন সফর বাধ্যবাধকতা বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু এর বাইরেও বিষয় রয়েছে। বাধ্যবাধকতা নয়, লন্ডন সফরের বিষয়টি ছিল বঙ্গবন্ধুর সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের ফল। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী লন্ডন সফরে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করেন। যদিও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী শর্তারোপ করেন। তবে বৈঠকটি নিঃসন্দেহে সফল ছিল।
বঙ্গবন্ধুর লন্ডন সফরের একটি কারণ হতে পারে ইংল্যান্ডকে জড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য প্রতিকূল শক্তির স্বীকৃতি আদায়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ের একটি সম্ভাবনা তৈরির পথ হয়তো তৈরি করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সেই আমলে রাশিয়া শুরু থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু অপর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন তো দেয়ইনি, উল্টো পাকিস্তানের সমর্থনে নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয়ী হওয়ার পর বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই তুলনামূলক সহনশীল অবস্থানে থাকা ব্রিটেনকে জড়িয়ে যদি বঙ্গবন্ধু পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি ত্বরান্বিত করার চিন্তা করে থাকেন, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ বঙ্গবন্ধুর মতো একজন দূরদর্শী নেতার এমন চিন্তাই স্বাভাবিক।
এর বাইরেও বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আবারও আলোচনায় আনার একটি সম্ভাবনা অনুমান করা যায়। এ ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য সে সময়ে জনসংযোগ কতটা প্রয়োজন ছিল তা বোধহয় বঙ্গবন্ধু খুব ভালো করেই অনুভব করতে পেরেছিলেন। এমনকি দীর্ঘ নয় মাসেরও বেশি সময় দেশে উপস্থিত না থেকেও তিনি সেটি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন, যা তার ১০ জানুয়ারির ভাষণ থেকে স্পষ্ট। ভাষণে তিনি দেশ গড়ায় কী কী প্রয়োজন তা দারুণভাবে বর্ণনা দিতে পেরেছিলেন। তাই লন্ডনে যাওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হতে পারে, সেখান থেকে বৈশ্বিক গণমাধ্যমের সহায়তায় বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের প্রয়োজন তুলে ধরা, যা তিনি তার সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে করেছিলেন। তাই ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর লন্ডন সফরকে এক ঢিলে একাধিক পাখি মারার মতো বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যা তার ব্যাপক দূরদর্শিতার প্রমাণ।
লন্ডনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো সময় ব্যয় করেননি বঙ্গবন্ধু। ৯ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের একটি বিশেষ বিমান দেয়া হয়। সাইপ্রাস ও ওমান হয়ে দিল্লিতে অবতরণ করেন ১০ জানুয়ারি এবং সেদিনই ফেরেন দেশে। চিন্তা-চেতনা, রাজনৈতিক একাগ্রতা ও দূরদর্শিতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে তার সমকালীন অনেক নেতার চেয়ে যুগ যুগ এগিয়ে ছিলেন, সে বিষয়টি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েই তার লন্ডনে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত থেকে স্পষ্ট।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post