বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের অভাবের কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশে টিকিট বিক্রি করে যে টাকা উপার্জন করছে, তা নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে এয়ারলাইন্সগুলো ঢাকা থেকে ২১টি এবং চট্টগ্রাম থেকে ২৪টি ফ্লাইট কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে, প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৯ হাজারেরও বেশি আসন কমে গেছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায়, টিকেটের দাম দ্রুত বাড়ছে।
এভিয়েশন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকিটের দাম বৃদ্ধির পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে। তারা উচ্চ ভ্রমণ কর, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ, ল্যান্ডিং ও পার্কিং চার্জ এবং ডলার সংকটকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি, তারা সম্প্রতি জারি করা গ্রুপ টিকিট সংক্রান্ত নতুন সরকারি পরিপত্রকেও এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন। তাদের অভিযোগ, এই পরিপত্রটি কোনো প্রকার বিচার-বিবেচনা ছাড়াই জারি করা হয়েছে এবং এর ফলে টিকিটের ভাড়া নিয়ে একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
নতুন পরিপত্রে বলা হয়েছে, কোনো এয়ারলাইন্স এখন থেকে ৭২ ঘণ্টার বেশি সময়ের জন্য টিকিটের বুকিং রাখতে পারবে না। বুকিং দেওয়ার তিন দিনের মধ্যেই যাত্রীর পাসপোর্ট নম্বর ও ছবিসহ টিকিট ইস্যু করতে হবে। অন্যথায়, বুকিং স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় আকাশপথে টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে এই নির্দেশনা জারি করেছে।
তবে, সরকারের এই সিদ্ধান্তে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো অসন্তুষ্ট। তাদের যুক্তি, বাংলাদেশে টিকিটের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে, কিন্তু ডলার সংকটের কারণে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আটকে আছে। এই আর্থিক ক্ষতির কারণ দেখিয়ে এবং টিকিট বিক্রির অর্থ দেশে নিতে না পারার কারণে, এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইট কমানোর মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, মন্ত্রণালয় ও এয়ারলাইন মালিকদের সংগঠন ‘বোর্ড অব এয়ারলাইন রিপ্রেজেন্টেটিভস বাংলাদেশ’ (বার) একাধিকবার আলোচনায় বসেও কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে পারেনি। বার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বিতর্কিত পরিপত্রটি বাতিল বা সংশোধনের অনুরোধ জানিয়েছে। তাদের মতে, এই ধরনের নিয়ম আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল আইনের পরিপন্থী এবং এটি এয়ারলাইন্সের স্বাভাবিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে। যদি এমন বিধিনিষেধ বহাল থাকে, তবে তা বাংলাদেশের ভ্রমণ বাজারের জন্য এবং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মন্ত্রণালয় অপরিকল্পিতভাবে এই পরিপত্র জারি করার কারণে টিকিটের দাম লাগামছাড়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই নতুন নিয়মের কারণে দেশীয় ট্রাভেল এজেন্সিগুলো আর অগ্রিম গ্রুপ বুকিং নিতে পারছে না, যার ফলে ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে বিদেশি অনলাইন ও ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর হাতে। কারণ, সরকারি পরিপত্রটি শুধু দেশীয় পর্যায়ে কার্যকর করা সম্ভব, আন্তর্জাতিকভাবে নয়।
বারের পক্ষ থেকে চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব অনুপ কুমার তালুকদার জানিয়েছেন, তারা বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী বৈঠকে আলোচনা করবেন। বারের জেনারেল সেক্রেটারি আহমেদ রেজা স্বাক্ষরিত চিঠিতে গ্রুপ টিকিট বিক্রির পরিপত্রকে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল আইনের লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের বুকিং পলিসি ভিন্ন হওয়ার কারণে সব টিকিটের জন্য ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা নির্ধারণ করা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, অনেক বাংলাদেশি যাত্রীর ভিসা পেতে এর চেয়ে বেশি সময় লাগে।
চিঠিতে গ্রুপ বুকিংয়ের প্রকৃত বিক্রয়মূল্য মন্ত্রণালয়কে জানানোর বিষয়েও আপত্তি জানানো হয়েছে। বারের মতে, এই ধরনের তথ্য প্রকাশ করা হলে বাজারে ‘প্রাইজ ফিক্সিং’ হতে পারে, যা দেশের এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আহমেদ রেজা স্পষ্ট করে বলেছেন, তাদের সদস্য এয়ারলাইনগুলো কোনোভাবেই টিকিট মজুদ করার পক্ষে নয়, যা বাজারে মূল্য বৃদ্ধি করে।
এদিকে, পরিপত্রের কারণে দেশীয় ট্রাভেল এজেন্টরা এখন গ্রুপ টিকিটের জন্য বিদেশি এজেন্সির শরণাপন্ন হচ্ছে, যার ফলে অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে চলে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে আকাশপথের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হুমকির মুখে পড়বে এবং পুরো অর্থ বিদেশে পাচার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই, জরুরি ভিত্তিতে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।