বিদেশ ভ্রমণে যেন উৎসব পালন করছেন সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। কারখানা পরিদর্শন, মালপত্র ক্রয়, প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপসহ নানা বাহানায় বিদেশ ভ্রমণ করছেন তারা। সরকারের আটটি মন্ত্রণালয়ের বিদেশ ভ্রমণের নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, গত দেড় মাসেই অন্তত সাড়ে ছয়শ কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি নিয়েছেন। এর মধ্যে অনেকেই ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরেছেন। কেউ কেউ এখনো বিদেশে অবস্থান করছেন। আর যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাকিরা। মন্ত্রণালয় থেকে তাদের ভ্রমণসূচি অনুমোদন করা হয়েছে। তবে ওই তালিকায় শিক্ষা ছুটি, ব্যক্তিগত ভ্রমণ, ওমরাহ কিংবা চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বিদেশে গমনের হিসাব ধরা হয়নি। এ ধরনের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বিদেশে যাওয়া কর্মকর্তাদের তালিকা আরও অনেক লম্বা।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের নভেম্বরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারি কর্মকর্তাদের সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। তখন বলা হয়েছিল, সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং আওতাধীন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, পাবলিক সেক্টর করপোরেশন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর সব পর্যায়ের কর্মকর্তার সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণ পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
এ ছাড়া স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, পাবলিক সেক্টর করপোরেশন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর নিজস্ব অর্থায়নেও সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ থাকবে। তবে বৈদেশিক সরকার, প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ অর্থায়নে স্কলারশিপ, ফেলোশিপের আওতাধীন মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়ন এবং বৈদেশিক সরকার, প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগীর আমন্ত্রণে ও সম্পূর্ণ অর্থায়নে আয়োজিত বিশেষায়িত পেশাগত প্রশিক্ষণ ও সেমিনারে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে সীমিত আকারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে বিদেশ ভ্রমণ করা যাবে বলে পরিপত্রে জানানো হয়েছে।
আটটি মন্ত্রণালয়ের চলতি বছরের ১ আগস্ট থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের বিদেশ ভ্রমণ সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কালবেলা। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেসব কাজে কর্মকর্তারা বিদেশে যাচ্ছেন, সেই কাজের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র নেই। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারির পর এই খাতে সরকারি অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা কমলেও কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ থামেনি। সংশ্লিষ্ট দেশ, প্রতিষ্ঠান কিংবা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খরচে বিদেশ থেকে ঘুরে আসছেন তারা।
গত ১ সেপ্টেম্বর জাপানের নারিতায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়। ফ্লাইটের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে জাপান যায় ৭৯ জনের বিশাল বহর। এর মধ্যে ছিলেন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর নেতৃত্বে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ২০ কর্মকর্তা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ বিমানের ২৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল। এই তালিকায় ছিলেন বিপণন, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য বিভাগের পরিচালক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এর বাইরে প্রতিনিধিদলে ২১ জন সাংবাদিক, ট্রাভেল এজেন্সিসহ অন্য সংস্থার ১৪ জন প্রতিনিধি ছিলেন।
শুধু জাপান সফরই নয়, গত দেড় মাসে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আরও প্রায় ৬৯ জন কর্মকর্তা বিদেশ গমনের জন্য সরকারের অনুমোদন নিয়েছেন। এর মধ্যে অনেকেই ভ্রমণ সেরে দেশে ফিরেছেন। আর অনুমোদন পেয়ে অনেকে এ মাসেই রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দেড় মাসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ১৫২ কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি নিয়েছেন। এই তালিকায় ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোর সংখ্যাই বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দলবেঁধে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এককভাবে ভ্রমণ করেছেন কর্মকর্তারা।
নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদেশ গমনের তালিকায় আছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রায় শতাধিক কর্মকর্তা। এ ছাড়াও শিল্প মন্ত্রণালয়ের ৮৭ জন, স্থানীয় সরকার বিভাগের ৭৭ জন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ২৫ জন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ৫৪ জন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৮৮ জন কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণে গেছেন কিংবা যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের চার প্রকৌশলী চীনে গেছেন চলতি মাসের ৯ তারিখে। তারা ফিরবেন ২১ তারিখে। এই ভ্রমণের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে ‘কনস্ট্রাকশন অব মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং অ্যাট অফিসার্স ক্লাব ক্যাম্পাস’ প্রকল্পের মালপত্রের প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন। আর এই ভ্রমণের সব ব্যয় বহন করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
তবে গণপূর্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশনের জন্য ১৩ দিন বিদেশে থাকার প্রয়োজন হয় না। এটা মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কর্মকর্তাদের বিনোদনমূলক উপহার। একইভাবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ১০ জন কর্মকর্তা জাপান ভ্রমণ করেছেন ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত। কাগজপত্রে বলা হয়েছে, কমপ্রেশর মেইনটেনেন্স এবং অপারেশন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্যে জাপান গেছেন তারা। এই সফরের ব্যয় বহন করে জাপান ও চীনের তিনটি কোম্পানি।
আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভ্রমণকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে অর্থায়নকারী প্রকল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। ‘মেরিন অ্যান্ড ফরেস্ট প্রটেক্টেড এরিয়া ইন জার্মানি’ পরিদর্শনে আগামী ১-১২ অক্টোবর দেশটিতে ভ্রমণ করবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ৯ কর্মকর্তা। এই তালিকায় আছেন মন্ত্রণালয়ের ২ যুগ্ম সচিব এবং ২ উপসচিব। প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তা যে কোনো সময় অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে যাবেন, এটাই তাদের চাকরির স্বাভাবিক প্রবণতা। ফলে জার্মানিতে তাদের এই ভ্রমণে বন মন্ত্রণালয় দীর্ঘমেয়াদে কতটা উপকৃত হবে—তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা নিজের মনমতো চাইলেই বিদেশে যেতে পারেন না। প্রত্যেকেরই জিও দরকার হয়। এই জিও ইস্যু করার একটা অথরিটি আছে। সেক্ষেত্রে অথরিটি জিও ইস্যু করলে সরকারি কর্মকর্তাদের দোষ দেওয়া যায় না।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি প্রয়োজনে যারা যাচ্ছেন, তারা সরকারি আদেশ নিয়েই যাচ্ছেন। সুতরাং আদেশ যে কর্তৃপক্ষ লেভেলে হচ্ছে, সেই কর্তৃপক্ষের দায়। সরকারের যে বিধিমালায় ভ্রমণ ব্যয় কমানোর কথা বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ সেটাই নিশ্চয়ই করে। এই আদেশগুলো যারা করছেন, তারা বুঝেশুনেই করছেন। এবং এটা দেখভালের জন্যে কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তাদেরই নজরদারি করতে হবে।’ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি যে নির্দেশনা সেটা তুলে দেওয়া হয়নি। এখনো বহাল আছে। এর পরও নিয়ম লঙ্ঘন হতাশাব্যাঞ্জক। একটা বড় সংখ্যক কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন। তবে দেশবাসী প্রত্যাশা করে ভ্রমণ যদি একেবারেই অপরিহার্য হয়, তাহলেই তা অনুমোদন হতে পারে। অপরিহার্য না হলে অনুমোদন বন্ধ করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘যারা বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে বিদেশ ভ্রমণের অনুমোদন নিচ্ছেন, সুযোগ নিচ্ছেন, সরকারি অর্থ ব্যয় করছেন। তাদের পাশাপাশি যারা অনুমোদন দিচ্ছেন তাদেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিদেশ ভ্রমণে যে নির্দেশনা রয়েছে, সেটি মান্য করার চর্চা করতে হবে। দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। আর যদি না হয় তবে সেটি অপ্রত্যাশিত।’
আপনার মন্তব্য: