করোনা মহামারির শুরুর দিকে এর গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা ছিল বিজ্ঞানীদের। তবে বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে করোনা সংক্রমণের অনেক কিছুই উদ্ঘাটন করতে সমর্থ হয়েছেন। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় অক্সিজেনের গুরুত্ব, রক্তজমাট বাঁধার মতো জটিলতা নিরসনে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ইত্যাদির ব্যবহার শুরু হয়।
এখন পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক বা কোনো কার্যকর অ্যান্টিভাইরাস–জাতীয় ওষুধের তেমন একটা সফলতা না পাওয়ার বিষয়টিও পরিষ্কার হয়। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ ইত্যাদি কোমর্বিডিটি থাকা বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি বেশি। তাই এদিকে নজর দেওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।
সম্প্রতি এসব নানামুখী জটিলতার মধ্যে নতুন যে জটিলতা নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে সেটি হলো, কালো ছত্রাক (ব্ল্যাক ফাঙ্গাস) বা মিউকরমাইকোসিস। ভারতে সম্প্রতি আক্রমণাত্মক দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রসঙ্গের সঙ্গে আকস্মিকভাবেই আলোচনায় এসেছে একধরনের ছত্রাকের সংক্রমণ, যা অন্ধত্ব ও মৃত্যুঝুঁকি হিসেবে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।
কালো ছত্রাক বা মিউকরমাইকোসিস কী
মিউকরমাইকোসিস হলো একধরনের ছত্রাক বা ফাঙ্গাস। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, আর্দ্রতাপ্রবণ ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ছত্রাকের বিকাশের অনুকূল পরিবেশ। জৈবপদার্থ, যেমন খাবার ইত্যাদিতে এরা খুব সহজেই জন্মাতে পারে। ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ আর্দ্রতায় যেমন সহজেই জন্মায়, তবে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে, অর্থাৎ রেফ্রিজারেটরে এরা কম বৃদ্ধি পায়।
ছত্রাকগুলো দেখতে গাছের ডালপালার মতো বিন্যস্ত থাকে এবং এদের গায়ে একধরনের স্পোর বা গুটির মতো দেখা যায়। যদিও এটি খালি চোখে দেখা যায় না, তবে একজায়গায় বংশবৃদ্ধি করে অনেক বেশি বিস্তৃত হলে খালি চোখে দেখা যেতে পারে। কালো রঙের স্পোরগুলা হলো একধরনের সূক্ষ্ম গুটির মতো অংশ, যা বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক। স্পোরগুলো আসলে ছত্রাকের প্রজনন অঙ্গ। এই স্পোরগুলো ফুলে রেণুর মতো বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে। অতিবেগুনি (আল্ট্রাভায়োলেট) রশ্মিতে এগুলো নষ্ট হয় না।
সংক্রমণ প্রক্রিয়া
মিউকরমাইকোসিসের স্পোরগুলো যখন বাতাসে ভেসে বেড়ায়, তখন নিশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসনালিতে প্রবেশ করে। প্রাথমিক অবস্থায় হালকা একটু অ্যালার্জি বা প্রদাহের সৃষ্টি করে। তবে দীর্ঘসময় ধরে বিদ্যমান থাকলে এবং দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে দ্রুত বাড়তে থাকে। স্পোরগুলো শাখা–প্রশাখার মতো বিস্তার লাভ করে ক্রমে অগ্রসর হতে থাকে এবং একসময় নাকের সাইনাস, চোখ বা চক্ষুকোটরের গভীরে ছড়িয়ে পড়ে।
ছত্রাকটির ভয়াবহ দিক হলো, এটি রক্তনালির গায়েও বিস্তারলাভ করতে পারে এবং একপর্যায়ে রক্তনালিকে ব্লক বা বন্ধ করে দেয়। ফলে রক্তসঞ্চালনবঞ্চিত কোষ বা টিস্যুগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। এই ধ্বংসযজ্ঞে মিউকরমাইকোসিস নিসৃত একধরনের টক্সিনও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিষয়টি এতই ভয়ংকর যে তা চোখ, চেখের পাতার মতো নরম অংশ, এমনকি চক্ষুকোটর, নাক ও চোয়ালের হাড়কেও ক্ষয় করে দিতে পারে। চক্ষুকোটর থেকে সরাসরি এটি মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করতে পারে।
করোনা ও কালো ছত্রাক
ছত্রাকটি স্বাভাবিক অবস্থায় খুব একটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবে যাঁদের দেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বা ইমিউনিটি কম, যেমন এইচআইভি, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, ক্যানসারের চিকিৎসাধীন, অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা, বিশেষ করে কিডনি, যকৃৎ ইত্যাদি সংযোজন করা ব্যক্তি, সর্বোপরি স্টেরয়েড ব্যবহারকারীরা এই মিউকরমাইকোসিসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার আরও দুই ধাপ অবনমন ঘটে।
করোনাভাইরাস দেহের ইমিউনিটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। তার ওপর করোনার চিকিৎসায় বিভিন্ন মাত্রায় এবং মেয়াদে স্টেরয়েড ব্যবহারের কারণে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার আরও এক ধাপ অবনমন ঘটে। ফলে খুব সহজেই মিউকরমাইকোসিসের সংক্রমণটি ভয়াবহ রূপ নেওয়ার সুযোগ পায়।
সতর্কতা
করোনা চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহারে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সুবিবেচনার সঙ্গে স্টেরয়েড ব্যবহার করতে হবে।
করোনা রোগীর চোখের বা নাকের আশপাশে কালো সংক্রমিত স্পট, নাকে রক্তক্ষরণ, চোখ বা নাকের আশপাশের ত্বকে টিস্যুক্ষয় দেখা দিলে বা হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে বা চোখ ফুলে গেলে সতর্ক হতে হবে। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ এবং একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
আক্রান্ত বা ক্ষতস্থান থেকে কোষের নমুনা (টিস্যু স্যাম্পল) নিয়ে বায়োপসি করে মিউকরমাইকোসিস শনাক্ত করা যায়।
মিউকরমাইকোসিস শনাক্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে। এর চিকিৎসা হলো এমফেটারিসিন–বি, যা শিরায় প্রয়োগ করতে হয়।
করোনা চিকিৎসাধীন রোগীর বিছানাপত্র যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সময়ে পরিবেশের ওপর নজর রাখতে হবে।
ইতোমধ্যে রোগটি বাংলাদেশেও দুইজন কোভিড রোগীর শরীরের শনাক্ত হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য অধিদফতর এই রোগটি নিয়ে সতর্ক বার্তা জারির কিছুদিনের মধ্যে রোগটি শনাক্ত হয়।
নির্দেশিকা বলছে, ডায়াবেটিসের রোগী, ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে যাদের, স্টেরয়েড ব্যবহারকারী ও বেশি মাত্রায় কোভিড সংক্রমণ হওয়া ব্যক্তিদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগের উপসর্গ:
* নাক থেকে কালচে রক্তপাত বা তরল বেরোনো।
*নাক বন্ধ, চোখ খুলতে বা বন্ধ করতে সমস্যা।
* মুখ অসাড় হয়ে যাওয়া। চোয়াল নাড়াতে কষ্ট।
* অ্যালার্জির উপসর্গ: প্রাথমিক অবস্থায় সর্দি, হাঁচি–কাশি, চুলকানি ইত্যাদি।
প্রদাহজনিত উপসর্গ: সাইনোসাইটিসের লক্ষণ, যেমন মাথাব্যথা, নাক বন্ধ বা নাক দিয়ে পানি ঝরা ইত্যাদি।
কোষকলায় সংক্রমণ: চোখ আক্রান্ত হলে চোখ ফুলে যাওয়া বা চোখ লাল, দৃষ্টি সমস্যা ইত্যাদির সঙ্গে চোখের গভীরে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। ফুসফুস আক্রান্ত হলে শ্বাসকষ্ট, সাইনাসের জটিলতায় নাক দিয়ে রক্ত ঝরার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় চোখের পাতা বা নাকের উপরিভাগের ত্বকে কালো ক্ষত দেখা দেয়। টিস্যু ক্ষয়: এর প্রভাবে অঙ্গহানির মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়।
উপসর্গ দেখা দিলে খেয়াল রাখতে হবে যেসব বিষয়:
* দিনের আলোয় নিয়মিত মুখের ভিতর আর নাক দেখতে হবে। কোথাও কোনও কালো জমাট ছোপ পড়েছে কি না নজর রাখতে হবে।
* দাঁত নড়বড় করছে কি না দেখতে হবে।
উপসর্গের পর সমস্যা হলে যা করতে হবে:
* চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
* নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হবে।
*চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেতে হবে।
* নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওষুধ খাওয়া যাবে না।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post