রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্রবাসী কোটায় ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন তানভীর মাহমুদ। এর জন্য রাজউকের কোষাগারে তিনি ৩০ লাখ টাকা জমা দিয়েছিলেন। ১০ নম্বর সেক্টরের ১০৭ নম্বর রোডের ৪৭ নম্বর প্লটটি তানভীর পরে বেচে দিয়েছেন মো. মেজবাহুল হকের কাছে। রাজউক গত বছরের ২৩ নভেম্বর বিক্রির অনুমতি দিয়েছে।
তানভীর প্লটটি ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করার তথ্য দেন রাজউকের কাছে। যদিও বর্তমানে পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট ১২-১৫ কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পূর্বাচলে ১০ নম্বর সেক্টরে ৩০১ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর প্লটটি প্রবাসী কোটায় বরাদ্দ পেয়েছিলেন সৈয়দ মোস্তফা বেলাল।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি নাবিলা হাসানের কাছে তা বিক্রি করেছেন। ২৬ নম্বর সেক্টরে ৪০২/বি সড়কে প্রবাসী ক্যাটাগরিতে বরাদ্দ পাওয়া ৪ নম্বর প্লটটিও ৩১ জানুয়ারি বিক্রি হয়ে গেছে। বরাদ্দগ্রহীতা মো. মোখলেছুর রহমান ৭ কাঠা আয়তনের প্লটটি বেচে দিয়েছেন উত্তরার বাসিন্দা শরিফুল ইসলামের কাছে।
পূর্বাচলে প্রবাসী কোটায় বরাদ্দ দেওয়া প্লটের অর্ধেকই এভাবে বিক্রি হয়ে গেছে। রাজউক সূত্রে জানা যায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ২৫ হাজার ১৬টি প্লটের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার প্লট প্রবাসী কোটায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ওই ৪ হাজার প্লটের অর্ধেকের মতো এরই মধ্যে বেচে দেওয়া হয়েছে অন্যের কাছে। প্রবাসী কোটায় বরাদ্দগ্রহীতাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন নকশা পাস করালেও বাড়ি বানাননি।
এর কারণ খুঁজতে গিয়ে রাজউকের কর্মকর্তারা জানতে পারেন, যাঁদের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই উন্নত দেশগুলোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত আর অন্যরা বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। ফলে তাঁরা পূর্বাচলে বাড়ি বানানোর তাগিদ অনুভব করছেন না। শুধু কাগজ হস্তান্তর করে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে রাজউকের সদস্য (এস্টেট) মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রবাসী কোটার প্লট বিক্রি কী পরিমাণ হয়েছে তা সঠিক বলা কঠিন। তবে হস্তান্তর করা হচ্ছে অনেক। কোনো বরাদ্দগ্রহীতা যদি নিয়ম মেনে প্লট বিক্রি করতে চান, তখন আমরা আটকে রাখতে পারি না।’
এ প্রকল্প নিয়ে কাজ করা এক প্রকৌশলীর মতে, যাঁদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাঁরা কাঠাপ্রতি শ্রেণিভেদে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। রাজউক এই জমির উন্নয়নকাজ করে তা কাঠাপ্রতি শ্রেণিভেদে ২ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকায় বরাদ্দ দিয়েছে। সেই জমি বিভিন্ন সময়ে একেক কাঠা ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন বরাদ্দগ্রহীতারা।
রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ভূমি শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পূর্বাচলে গত কয়েক বছরে যত প্লট হস্তান্তর বা বিক্রি হয়েছে, তার বেশির ভাগই প্রবাসী কোটার।
পূর্বাচল প্রকল্পটি তিন দশকেও বাসোপযোগী না হওয়ার জন্য প্লট বরাদ্দের পদ্ধতি দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, প্লট বরাদ্দ দেওয়ার পদ্ধতিটি ত্রুটিপূর্ণ। নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, যেখানে দেশে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের চরম আবাসনসংকট রয়েছে, সেখানে এই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রকল্পে প্লটগুলোর একটা বড় অংশ গেছে প্রবাসী কোটায়। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কাজ।
রাজউকের তথ্যমতে, পূর্বাচল প্রকল্পে আবাসিক প্লটের মধ্যে আছে ৩ কাঠা আয়তনের ১০ হাজার ১২টি, ৫ কাঠার ১০ হাজার ৩৬১টি, সাড়ে ৭ কাঠার ২ হাজার ৬১৮টি, ১০ কাঠার ২ হাজার ২৫টি। ২৫ হাজার ১৬টি প্লটের মধ্যে ২৪ হাজার ৮৪২টি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫৭টি প্লট বরাদ্দ প্রক্রিয়াধীন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই প্রকল্পে মোট ৬ হাজার ২১৩ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য খরচ হয়েছে ৫৪২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতি বিঘা জমি অধিগ্রহণে খরচ হয়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা। কাঠাপ্রতি খরচ কমবেশি ১৪ হাজার টাকা।
পরে রাজউক তিন কাঠা আয়তনের প্লটের জন্য কাঠাপ্রতি ২ লাখ টাকা, পাঁচ কাঠার জন্য ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা, সাড়ে সাত কাঠার জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ১০ কাঠা আয়তনের প্লটের জন্য ৩ লাখ টাকা করে নিয়ে বরাদ্দ দিয়েছে।
ফলে তিন কাঠার প্লটের জন্য বরাদ্দগ্রহীতাকে রাজউকের কোষাগারে জমা দিতে হয়েছে ৬ লাখ টাকা; পাঁচ কাঠার প্লটের জন্য দিতে হয় ১১ লাখ ২৫ হাজার; সাড়ে সাত কাঠার প্লটের জন্য ১৮ লাখ ৭৫ হাজার এবং ১০ কাঠার প্লটের জন্য ৩০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। সেই জমি যাঁরা প্রবাসী কোটায় পেয়েছেন, তাঁরা কাঠাপ্রতি ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন।
রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রাজউক প্লটগুলো কম দামে বরাদ্দ দেওয়ায় মোট অর্থের ওপর কম পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে। একই কারণে সরকারও নিবন্ধন কর কম পাচ্ছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘যাঁরা দেশেই থাকেন না তাঁদের প্লটে তো বাড়ি হচ্ছে না। তাঁদের বাড়ি করার তাগিদ নেই।
তাঁরা এসব জমি ২৫-৩০ গুণ বেশি দামে বিক্রি করে দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। আসলে জমি তো বিক্রি হচ্ছে না; বিক্রি হচ্ছে একটি কাগজমাত্র। এভাবে জমির মালিকদের নিঃস্ব করে ধনীকে আরও ধনী বানানোর কোনো যুক্তি দেখছি না।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post