২০০৭ সালে সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত “বাঁধন” নামে একটা ম্যাগাজিনে ‘প্রবাসীদের ভোটাধিকার এবং প্রতিনিধিত্ব’ শিরোনামে আমার লেখা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটির একটি চিত্রলিপি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আলোচনা করতে চাই।।
লেখাটির মূল বক্তব্যের কোনো পরিবর্তন আজও হয়নি। সময়ের সাথে সাথে শুধুমাত্র সংখ্যা ও অংকের কিছু পরিবর্ধন হয়েছে মাত্র। যেমন প্রবাসীর সংখ্যা ৪০ লাখের পরিবর্তে ১.৩০ কোটি এবং রেমিটেন্স ৫ বিলিয়নের পরিবর্তে প্রায় ২৪ বিলিয়ন হয়েছে। আমি কোনো সেলিব্রেটি, খ্যাতিমান ব্যক্তি বা চিন্তাবিদ নই। একজন প্রবীণ প্রবাসী-দীর্ঘ বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রবাসীদের জন্যে যে বিষয়গুলো উপলব্ধি এবং চিন্তা করেছি তার আলোকে প্রতিবেদনটি লিখেছিলাম।
দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান, পদে পদে তাদের প্রতি বঞ্চনা, প্রবাসীদের প্রাপ্য অধীকার, প্রবাসীদের কল্যানে শক্ত সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা, প্রবাসীদের ভবিষ্যত, দেশের কাজে প্রবাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ের উপর গুরুত্ব ও আলোকপাত করাই প্রতিবেদনটির মূল বক্তব্য এবং লক্ষ্য ছিলো। দেশে আমার থেকে অনেক বড় বড় চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, নীতিনির্ধারক, প্রশাসক এবং প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও প্রবাসীদের ভোটাধিকারসহ মৌলিক অধিকারের অনেক কিছুই গত পনেরো বছরেও বাস্তবায়িত হয় নাই। এ থেকে বোঝা যায় বিভিন্ন সভা-সেমিনারে, বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রবাসীদের জন্য যা কিছু বলা হয় তার অনেকটাই ‘মায়াকান্না’ এবং যা সামান্য কিছু করা হয় তা ‘করুণা’ মাত্র।
সকলকে মনে রাখতে হবে এবং বুঝতে হবে যে, প্রবাসীরা বকশিশ বা প্রণোদনা চায় না, করুণা চায় না। তাদের অধিকার চায়, সম্মানজনক স্থান চায়। সচ্ছল ,সুখী-সম্মৃদ্ধ এবং নিরাপদ জীবন চায়। এবং দেশ গঠনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন চায়।
বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত জাতীয় প্রবাসী দিবস- ২০২৩ উপলক্ষ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর একই দাবির পুনরুল্লেখ করতে চাই। ক্রমান্বয়ে দাবিগুলো হলো:
১) সকল প্রবাসীদের (প্রবাস থেকে) ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
২) বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদ-এ প্রবাসীদের জন্য ন্যূনতম ত্রিশ (৩০) টি সংরক্ষিত আসন রাখতে হবে। যাতে করে প্রবাসী প্রতিনিধিরা প্রবাসীদের জন্যে কল্যাণমুলক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং নীতি নির্ধারণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।
৩) প্রবাসীদের জন্য ভবিষ্যত উন্নয়নমুখী, টেকসই এবং দীর্ঘমেয়াদি বিবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি শক্ত প্রবাসী ‘সংগঠন’ গঠনে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান। (এ বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী নারী, পুরুষ সকলকে উদ্যমী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে)
৪) দেশের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে সাথে প্রবাসীদের অবদান উল্লেখ করে প্রবাসীদের প্রতি সন্মান জানানো প্রবাসীদের ন্যায্য প্রাপ্য বলে মনে করি। কেননা প্রবাসীদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সিংহ ভাগ যোগানের মাধ্যমেই বড় বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে।
৫) বিদেশে প্রবাসীদের ছেলে / মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্যে বাংলাদেশ সরকারের খরচে পর্যাপ্ত স্কুল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে এবং সাথে সাথে বিদ্যমান, চলমান স্কুল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।
৬) বিদেশে প্রবাসী মেধাবী ও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্যে শিক্ষা সহযোগিতা এবং আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ।
৭) দেশে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য শুধুমাত্র শ্রমভিত্তিক উপার্জনের উপর নির্ভরশীল না থেকে বিদেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ এবং শিল্পায়নের মাধ্যমে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। নিজেদের সমৃদ্ধ ব্যবসা, বাণিজ্যের সাথে সাথে বহু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এ লক্ষ্যে বিদেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ব্যাবসায়িক সম্প্রসারণে সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ। বিশ্বায়নের (GLOBALIZATION) এই যুগে নিজ দেশে ব্যবসা, বাণিজ্যের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
৮) প্রবাসীদের জন্যে জীবন বীমা, পেনশন স্কিম (যদিও ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে) চালু করে তা প্রবাসীবান্ধব করা।
৯) অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং ঋণের ভারে জর্জরিত প্রবাসীদের জীবন রক্ষার্থে জরুরি আর্থিক সহযোগিতা এবং ঋণ প্রদান প্রকল্প চালুকরণ।
১০) প্রবাসী মহিলা কর্মীদের বিদেশে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিধানে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এছাড়া সময়ের সাথে সাথে প্রবাসী সংগঠন-এর মাধ্যমে সময় উপযোগী প্রয়োজনীয় উন্নয়নমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ, ঘোষিত ‘জাতীয় প্রবাসী দিবস’কে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত সৃজনশীল পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বিবৃত বিষয়গুলি বাস্তবায়নের আবেদন রইলো। ‘প্রবাসী জীবনের-সুন্দর আগামী’ এই শুভাকাঙ্খার সাথে সাথে অগণিত প্রবাসী ভাই-বোন সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।
লেখক
কাজী নাজমুল হাসান
মাস্কাট, ওমান
Email: [email protected]
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post