হতাশা ও মানসিক চাপে আজকাল থাকেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুর্গম। কম-বেশি সবাই মানসিক চাপ ও উদ্বেগে থাকে। মনে হয় তা যেন এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই উল্লিখিত আমলগুলো অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
যারা ইমান আনে ও আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। জেনে রেখ, আল্লাহর স্মরণেই শুধু হৃদয় প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ, আয়াত ২৮)
মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের কে বেশি বেশি হাদিস কোরআন পড়তে হবে এবং আমাদের সমস্যার সমাধান খুঁজে বেইর করতে হবে। আল্লাহ্ উপর ভরসা রাখতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে যা কিছু হয় আমাদের ভালোর জন্যই হচ্ছে হয়তো জ্ঞান স্বল্পতার জন্য আমরা তা বুঝতে পারছি না। আমরা আমাদের যায়গা থেকে যা করতে পারি তা হলো চেষ্টা ফলাফল দেওয়ার মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ্ তায়ালা।চেষ্টা করে যদি আমরা সফল হতে না পারি তাহলে বুঝতে হবে এটা আমার জন্য না কিংবা আমার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রয়েছে।তবে আমার এই চেষ্টার উত্তম প্রতিদান নিশ্চয়ই একদিন পাবো।
নানাবিধ দুশ্চিন্তা ও হতাশার কারণে মানুষের মাঝে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়।কেউ কেউ সমাধান হিসেবে বেছে নেয় আত্মহত্যা কে আবার কেউ জীবনের স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়ে ফেলে। বিশ্বাস অবিশ্বাস থেকে অশান্তি আর সেখান থেকে জন্ম নেয় বিভিন্ন কৃত্রিম সংকট ও সমস্যা। কেউ কেউ তা মোকাবেলা করতে পারে কেউ কেউ পারে না। সহজ সমাধান খুঁজতে গিয়ে কেউ পথ হারিয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে আর মুমিনগণ মাথা অবনত করে মহান আল্লাহ্ দরবারে। মুসলিম হিসাবে আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে এমন কোনো রোগ নেই যার চিকিৎসা আল্লাহতায়ালা দেননি। মানসিক চাপসহ নানাবিধ রোগবালাই থেকে উত্তরণে ইসলামি ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর।
অহেতুক দুশ্চিন্তা অনেকটা চক্রের মতো। যত দূর করতে চাইবেন, তত আপনাকে জেঁকে ধরবে। কথায় আছে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’ মস্তিষ্ক যত অলস বসে থাকে, তত মাথায় জমা হয় অহেতুক চিন্তা।
তাই নিজেকে ব্যাস্ত রাখুন, আপনার ভালো লাগে এমন ভালো কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করুন। জীবনে পাওয়া না পাওয়ার বেদনায় হতাশ হওয়া কিংবা মানসিক চাপ অনুভব করা নতুন কোনো বিষয় নয়। বিপদ-আপদ, চাপ কিংবা না পাওয়ার বেদনা যত বেশিই হোক না কেন কোনো অবস্থায়ই হতাশ হওয়া ঈমানদারের কাজ নয়। বরং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর ওপর আস্থা রাখাই সুস্থ থাকার উপায় এবং বুদ্ধিমানের কাজ।
সাদাত হোসাইনের একটা লাইন আছে, ‘যা আমার নয় তা পেয়ে গেলেও আমার নয় আর যা আমার তা না পেলেও আমার কখনো মুক্তিই বন্দিত আবার কখনো কখনো বন্দিত্বই মুক্তি’ মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে এটা একটা চমৎকার যুক্তি। যুবক-যুবতীদের মধ্যে প্রেম সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা স্বামী-স্ত্রী মধ্যে সাংসারিক জটিলতা থেকে একজন অন্য জনকে কে ছেড়ে যাওয়া কিংবা কোনো কিছু না পাওয়া থেকে মানুষ হতাশ হয়ে পড়েন।
মানসিক অশান্তি থেকে মুক্ত থাকতে মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলের বিকল্প নেই। কেননা তিনিই বলেছেন, ‘যে মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল বা ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সূরা তালাক : আয়াত ৩)।
আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা ও পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপনে তার মনোবল বেড়ে যায়। ফলে সে অন্তরে খুঁজে পায় এক অনাবিল সুখ ও পরিতুষ্টি।
সুতরাং যে ব্যক্তি দুনিয়ায় সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল করতে জানে তার জন্য কোনো চিন্তা নেই। হাদিসে এসেছে-রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, আমি সেরূপ, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে।’ (বুখারি)।
মানসিক চাপ কমাতে নিয়মিত দোয়া করাও উচিত। কারণ হাদিসে দোয়াকে ইবাদতের মূল বলা হয়েছে। দোয়া বা প্রার্থনা করলে, কোনো কিছু চাইলে মহান আল্লাহ খুশি হন। না করলে বরং অসন্তুষ্ট হন। তবে দোয়ার ক্ষেত্রে হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলোকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি এমন একটি দোয়া সম্পর্কে জানি, কোনো বিপদে পড়া লোক যদি তা পড়ে তবে আল্লাহ সে বিপদ দূর করে দেন। সেটি হচ্ছে- আমার ভাই (হজরত) ইউনুস (আলাইহিস সালাম)-এর দোয়া। তাহলো, ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ্বালিমিন।
অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই; আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। নিঃসন্দেহে আমি জালেমদের অন্তর্ভুক্ত।’ -তিরমিজি
যে কোনো বিপদ-মুসিবত, পেরেশানির সময় নামাজের মাধ্যমেই প্রকৃত প্রশান্তি লাভ কর যায়। কেননা নামাজের মাধ্যমেই বান্দা মহান আল্লাহর সাহায্য লাভ করে থাকেন। তাই মানসিক প্রশান্তি লাভে নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহতায়ালা বলেন-‘তোমরা নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে আমার নিকটে সাহায্য প্রার্থনা কর। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সেসব বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব। (সূরা বাকারা : আয়াত ৪৫)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে নামাজ আদায় করতেন।’ (আবু দাউদ)। সাহাবায়ে কেরামও এ আমলে অভ্যস্ত ছিলেন। ছোট থেকে ছোট কোনো বিষয়ের জন্যও তারা নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে বেশি বেশি ইসতেগফারের বিকল্প নেই। যেসব কারণে মানুষ চাপে পড়ে, তন্মধ্যে অন্যায়-অপরাধ বেশি করা, অর্থ কষ্টে থাকা, সন্তানসন্ততি না থাকা, জীবিকার অপ্রতুলতা,বেকারত্ব সমস্যা, সামাজিক সমস্যা,পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি। এ সবের সমাধানে কুরআনের প্রজ্ঞান হলো ইসতেগফার করা। এ ইসতেগফারেই মানুষ উল্লিখিত সমস্যা থেকে সামাধন খুঁজে পায় বলে ঘোষণা করেছেন মহান আল্লাহ।
কুরআনে এসেছে-‘অতঃপর বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্য উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন।’ (সূরা নুহ : আয়াত ১০-১২)।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে, আল্লাহতায়ালা তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন। তার সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। -সুনানে আবু দাউদ
কুরআন তেলাওয়াত মানুষের অন্তরকে প্রফুল্ল করে তোলে হৃদয়কে করে প্রশান্ত। কেননা কুরআন তেলাওয়াত মুমিনের প্রফুল্লতার অনন্য উৎস। শুধু তাই নয়, কুরআন তেলাওয়াতে মুমিনের মনের প্রফুল্লতা ও মানসিক প্রশান্তি বাড়তে থাকে।
কুরআনের আলোয় আলোকিত মানুষ সব দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে মুক্ত থাকে। আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, আল্লাহ তাদের পবিত্র কুরআন দ্বারা শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে তাদেরকে কুফরির অন্ধকার থেকে বের করে ইমানের আলোর দিকে নিয়ে যান এবং তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন।’ (সূরা মায়িদা : আয়াত ১৫-১৬)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) হতাশা দুশ্চিন্তা দুঃখ-কষ্ট মানসিক চাপ থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে কীভাবে দোয়া করব তা বলে দিয়েছেন।
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাজানি, ওয়াল আজযি ওয়াল কাসালি ওয়াল বুখলি ওয়াল জুবনি ওয়া দ্বালাইদ-দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।’ হে আল্লাহ! আমি দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও লোকজনের প্রাধান্য থেকে আপনার কাছে পানাহ চাচ্ছি। -সহিহ বোখারি: ২৮৯৩
দরুদ পড়লে আল্লাহতায়ালা বান্দার প্রতি রহমত নাজিল করেন। এ রহমত মানুষকে যাবতীয় মানসিক চাপ থেকে মুক্ত রাখে। এটি আত্মপ্রশান্তি লাভের সহজ উপায়ও বটে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরুদ পড়া এমন একটি ইবাদত যে, আল্লাহতায়ালা তা কবুল করে নেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বর্ণনা করেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার ওপর অনেক বেশি দরুদ পড়তে চাই। আপনি বলে দিন আমি দরুদে কতটুকু সময় দেব? তিনি বললেন, ‘তুমি যতটুকু চাও! আমি বললাম, এক চতুর্থাংশ সময়?
তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও! যদি আরও বাড়াও তা তোমার জন্য ভালো। আমি বললাম, অর্ধেক সময়? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু সময় পড়তে পার, যদি এর চেয়ে আরও সময় বাড়াও তোমার জন্য ভালো। আমি বললাম, তাহলে সময়ের দুই তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও, যদি আরও বাড়াও তোমার জন্য ভালো। আমি বললাম, সম্পূর্ণ সময় আমি আপনার ওপর দরুদ পড়ায় কাটিয়ে দেব। তখন তিনি বললেন, তাহলে এখন থেকে তোমার পেরেশানি দূর হওয়ার জন্য দরুদই যথেষ্ট এবং তোমার পাপের কাফফারার জন্য দরুদই যথেষ্ট।’ (তিরমিজি)।
সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ সবকিছুর ক্ষেত্রেই মুমিন তাকদিরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে। আর দুঃখ-হতাশা, অভাব-অনটন, বিপদ-আপদে তাকদিরের ওপর বিশ্বাস থাকলে কোনো মানুষই মানসিক চাপে ভোগে না। তাই মানসিক চাপের সময় মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাকদিরের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় রয়েছে মানসিক প্রশান্তি। আল্লাহ বলেন,আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দিলে তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা মোচন করতে পারে না। আর আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান, তাহলে তার অনুগ্রহ পরিবর্তন করারও কেউ নেই।-সুরা ইউনুস : ১০৭।
মৃত্যুর স্মরণ মানসিক চাপকে একেবারেই মিটিয়ে দেয়। পরকালের কঠিন পরিস্থিতির কথা স্মরণ রাখলে দুনিয়ায় মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ফলে মানুষের দ্বারা কোনো অন্যায় কাজ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তখনই মানুষ থাকে মানসিক চাপমুক্ত। কারণ পরকালের তুলনায় দুনিয়ার বিপদ-আপদ একেবারেই নগণ্য। আল্লাহ বলেন-
যেদিন তারা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন তাদের মনে হবে, যেন তারা পৃথিবীতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক প্রভাত অবস্থান করেছে। (সূরা নাযিআত : আয়াত ৪৬)।
অনেক ক্ষেত্রেই হতাশা থেকে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। তাই দুনিয়ার জীবনে বিপদ-আপদে হতাশ না হওয়া ইমানদারের কাজ। যেকোনো সময়, যেকোনো ধরনের বিপদ-আপদ আসতে পারে এ মানসিকতা সব সময় পোষণ করা। ফলে তা মানুষকে বিপদে হতাশা থেকে রক্ষা করে মানসিক চাপমুক্ত রাখে। কোরআনে কারিমে এসব বিপদ-আপদ দিয়ে বান্দাকে পরীক্ষার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব সামান্য ভয় ও ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে; আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও- যাদের ওপর কোনো বিপদ এলে বলে, ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন’- নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর আর অবশ্যই আমরা তার কাছেই ফিরে যাব।’ – (সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৬)
তৌফিক সুলতান, প্রধান নির্বাহী পরিচালক, ওয়েলফশন মানবকল্যাণ সংঘ।
কাপাসিয়া,গাজীপুর।
01746501454
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post