দুর্নীতি দমন কমিশনের কড়া নজরদারিতে আনা হচ্ছে দুর্নীতিবাজদের। গত সাড়ে পাঁচ বছরে ঢাকাসহ সারা দেশ ১ হাজার ৭৮২টি মামলা করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। মামলা পর্যালোচনা করে নানা তথ্য পাওয়া গেছে। অনেকে মামলা থেকে রেহাই পেতে তদবির করছেন। এ নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা চিন্তিত। রাজনীতিকদের নামেও মামলা হচ্ছে। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা অনেক বেশি। যদিও যে হারে মামলা হচ্ছে, সে হারে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এর জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। কোনো কোনো মামলায় স্থগিতাদেশও দেওয়া হচ্ছে। ফলে বিচারপ্রক্রিয়া ঝুলে যাচ্ছে।
অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন, অর্থ পাচার, ঘুষ নেওয়া, জালিয়াতি ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করা হচ্ছে বেশি। বিভিন্ন বিচারিক আদালতে এখনো প্রায় তিন হাজার মামলা বিচারাধীন। উচ্চতর আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে বেশ কিছু মামলা। মামলা কবে শেষ হবে তা সংশ্লিষ্টরা বলতে পারছে না। মামলাসংশ্লিষ্টরা গণমাধ্যমকে জানান, অনেক দিন ধরেই দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে অভিযোগ আসছে। কিছু কিছু অভিযোগ আমলে নেওয়া হচ্ছে। নেতাদের মধ্যে কেউ সংসদ সদস্য, কেউ সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও জেলা-উপজেলার নেতা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, অধস্তন কর্মচারী ও সাবেক আমলা রয়েছেন।
অভিযুক্তদের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, আয়কর রিটার্নের কপি, ব্যাংকের হিসাব বিবরণী, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল এবং তাদের ওপর নির্ভরশীলদের চাকরি বা ব্যবসা অথবা অন্য উৎস থেকে প্রাপ্ত আয়ের বিবরণীসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ড তদন্তের পর কারোর বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। কারোর বিষয়ে বিস্তর তদন্ত চলছে। নাম প্রকাশ না করে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে তার বেশিরভাগের আসামি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। রাজনৈতিক নেতা ও সাবেক আমলাদের নামেও মামলা হচ্ছে। যেসব মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি তার কারণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আসামিরা নিজেদের বাঁচাতে নানা কায়দায় তদবির করছেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও কালক্ষেপণ করছেন। সাক্ষীরা ঠিকমতো আদালতে আসছেন না। উচ্চতর আদালতেও একই অবস্থা। তবে আমরা আশাবাদী দ্রুত সময়ে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে দুর্নীতির মামলা বেশি হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কাউকে দুদকে তলব বা মামলা হচ্ছে তা ঠিক নয়। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। সব পেশার লোকের বিরুদ্ধেই দুদকে অভিযোগ আসছে। নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইতে সরকারি কর্মকর্তা, বর্তমান ও সাবেক এমপিদের কেউ সরাসরি যোগাযোগ করছেন আমাদের সঙ্গে। দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও দেখা করার চেষ্টা করছেন কেউ। প্রভাবশালী রাজনীতিকদের মাধ্যমে চাপও দেওয়া হচ্ছে। রাজনীতির বাইরের লোকজনদের মাধ্যমেও তদবির চলছে। কিন্তু দুদক পিছু হটবে না। অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।’
দুদক সূত্র জানায়, গত সাড়ে পাঁচ বছরে যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। কয়েকজন আছেন বেসরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও অন্য পেশার লোক। আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে আসামির মধ্যে জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি আলোচিত মামলাগুলোর মধ্যে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উল্লেখযোগ্য। এ মামলায় আসামি হিসেবে আরও রয়েছেন গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম ও পরিচালক এসএম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফীসহ ১৩ জন।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের তহবিল লুটপাটের অভিযোগে ১১টি মামলা হয়েছে। তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ পরিবারের সদস্যদের, বিআইএফসির এমডিসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের আসামি করা হয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সাবেক পরিচালক ফ্লাইট অপারেশনস ক্যাপ্টেন ইশরাত আহমেদ, প্রধান প্রকৌশলী এআরএম কায়সার জামান, প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার শরীফ রুহুল কুদ্দুস, সাবেক ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল আলম সিদ্দিক, সাবেক মুখ্য প্রকৌশলী শহীদ উদ্দিন মোহাম্মদ হানিফ, দেবেশ চৌধুরীসহ ৩৩ জন, তিতাস গ্যাস টিঅ্যান্ডডি কোং লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সিদ্দিকুর রহমান, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ুন কবির, নরসিংদী সদরের বরখাস্তকৃত সাব-রেজিস্ট্রার নীহার রঞ্জন বিশ্বাস, রাজশাহীর উপ-কর কমিশনার মুহিবুল ইসলাম ভূঁইয়া, ডলি কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন, রূপালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক খালেদ হোসেন মল্লিক, সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, একই ব্যাংকের পল্টন শাখার উপমহাব্যবস্থাপক এএসএম মোরশেদ আলী, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌহিদুজ্জামান, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিন, ঢাকা ওয়াসার সাবেক রাজস্ব পরিদর্শক মিঞা মিজানুর রহমান, ওয়াসার সাবেক রাজস্ব পরিদর্শক হাবিব উল্লাহ ভূঁইয়া, কুয়েত-বাংলাদেশ সরকারি মৈত্রী হাসপাতালের স্টোর অফিসার হাবিবুর রহমান প্রমুখের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তাদের বিচার শুরু হয়নি। তারা নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করছেন। কেউ সরকারের ওপরমহলেও যোগাযোগ করছেন বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।
দুদক সচিব মাহবুব হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ছি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী যার বিরুদ্ধেই অভিযোগ আসে আমরা গভীরে গিয়ে তদন্ত করে মামলা করি। অহেতুক কাউকে হয়রানি করা হয় না।’ সূত্র জানায়, গত সাড়ে পাঁচ বছরে সারা দেশে ১ হাজার ৭৮২টি দুর্নীতি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১০২টি, ২০২২ সালে ৪০৬টি, ২০২১ সালে ৩৪৭টি, ২০২০ সালে ৩৪৮টি, ২০১৯ সালে ৩৬৩টি ও ২০১৮ সালে ২১৬টি মামলা হয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিম্ন আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের ৩ হাজার ২৯৫টি মামলা বিচারাধীন। তার মধ্যে ২ হাজার ৮৬৭টি মামলার বিচার কার্যক্রম চলমান থাকলেও উচ্চ আদালতের আদেশে ৪২৮টি মামলার বিচার স্থগিত রয়েছে।
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোনো মামলার একাধিক আসামি থাকলে যেকোনো একজন আসামির আবেদনে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ আসছে। স্থগিতাদেশ আসার পর কমিশনকে অবহিত করা হয়। স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়া হয়। এভাবে বেশ কিছু পুরনো মামলা সচল হয়েছে। তবে ঝিমিয়ে পড়া মামলাগুলো দ্রুত শেষ হওয়া উচিত। না হলে রাষ্ট্র বা সমাজ দুর্নীতিমুক্ত হবে না।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post