ইসলামের উৎসভূমি মক্কা ও মদিনা। যা বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত। প্রাচীন এই শহর দুটিতে অবস্থিত পবিত্র দুই মসজিদ ইসলামের অনুসারী তথা মুসলমানদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ দুই ধর্মীয় স্থান। এরপরই ফিলিস্তিনের জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদকে ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মক্কা ও মদিনার মসজিদের মতো প্রতিবছর ফিলিস্তিন ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মুসলমান এ মসজিদ প্রাঙ্গণে আসেন। কিন্তু মসজিদটিকে ঘিরে চলছে দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর বাড়াবাড়ি।
এখন নিয়মিতই পবিত্র আল-আকসা মসজিদে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইলি পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী। শুধু ইসরাইলি বাহিনী নয়, ইসরাইলি সেটেলার তথা অবৈধ স্থাপনকারীদেরকেও যখন-তখন এ মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়তে দেখা যাচ্ছে। সবশেষ বৃহস্পতিবারও একদল ইসরাইলি সেটেলার আল-আকসা মসজিদের প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ে। যথারীতি তাদের নিরাপত্তাও দিচ্ছিল ইসরাইলি পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ইসরাইলি সেটেলারদের একটি বড় দল একাধিক উপদলে বিভক্ত হয়ে পবিত্র মসজিদে ঢুকে পড়ে এবং এর প্রাঙ্গণে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। অথচ ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের আল-আকসায় প্রবেশ নিষিদ্ধ।
তা সত্ত্বেও ২০০৩ সাল থেকে ইসরাইলি দখলদার কর্তৃপক্ষ ইহুদিদের শুধুমাত্র শুক্রবার ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে। প্রতি শুক্রবার আল-আকসায় জুমার নামাজ আদায় করেন মুসলমানরা। গত কয়েক বছর ধরে পবিত্র রমজান মাস এলেই আল-আকসায় হামলা চালায় দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। ফলে ইসরাইলি বাহিনী ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। মসজিদটিকে দখলদারদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়।
আল-আকসা মসজিদ
১৪ হেক্টর এলাকাজুড়ে অবস্থিত আল-আকসা প্রাঙ্গণে রয়েছে আল-আকসা মসজিদ। এছাড়া আছে সোনালী গম্বুজবিশিষ্ট ‘ডোম অব দ্য রক’, যা জেরুজালেমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি স্থাপনা এবং এ দুটিই পবিত্র হিসেবে বিবেচিত। পূর্ব জেরুজালেমের পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত আল-আকসা মসজিদে ১৫টি গেট ছিল। যার মধ্যদিয়ে দিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেন জেরুজালেমের ওল্ড সিটি থেকে আসা ধর্মানুরাগীরা। যদিও এই গেটের মাত্র ১০টি এখন ব্যবহৃত হয়। এবং সেগুলোও নিয়ন্ত্রণ করে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইসরাইলি সেনা ও পুলিশ।
আল-আকসায় প্রথম ছোট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)। এরপর ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে এখানে প্রথম বড় আকারে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এরপর ভুমিকম্পে মসজিদটি দুবার ধ্বংস হয়ে গেলে তা পুনর্নির্মাণ করা হয়। কয়েকবার সংস্কার কাজও করা হয়। আল-আকসার ‘ডোম অব দ্য রক’ এর সোনালী গম্বুজ বহুদূর থেকে দেখা যায়। বাইরের দেয়ালসহ এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার বর্গমিটারের এই সীমানায় রয়েছে মসজিদ, নামাজের ঘর, উঠান ও ধর্মীয় বিভিন্ন স্থাপনা।
ইসলামে আল-আকসা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
আল-আকসা আরবি শব্দ। বাংলায় শব্দটির অভিধানগত অর্থ ‘সর্বোচ্চ’। ইংরেজিতে ‘দ্য সুপ্রিম’। কিন্তু আল-আকসা শব্দটি উচ্চারণ করলেই সবুজ গম্বুজ বিশিষ্ট অসাধারণ এক মসজদের ছবিই ভেসে ওঠে। যার অবস্থান ফিলিস্তিনের ওল্ড সিটি জেরুজালেমের প্রাণকেন্দ্রে।
আল-আকসা মসজিদের বিশেষ মর্যাদা এই কারণে যে, মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনে একে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সূরা আল ইসরা বা বনি ইসরাইলের ১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহীয়ান তিনি যিনি তার বান্দাকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারপাশকে আমি কল্যাণময় করেছি। তাকে আমার নিদর্শনাবলী দেখানোর জন্য, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’
এই আয়াতে মূলত পবিত্র মিরাজের রাতের কথা বলা হয়েছে। পবিত্র মিরাজে গমনের আগে রাত্রীকালে মহান আল্লাহ মহানবী হযরত মোহাম্মদকে (স.) মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদ পর্যন্ত ভ্রমণ করান। মিরাজ অর্থ হলো ঊর্ধ্বগমন। যে রাতে মিরাজ ঘটেছিল সেই রাতকে লাইলাতুল মিরাজ বা মিরাজের রাত বলা হয়। যা আমাদের এই অঞ্চলে শবে মিরাজ বলে পরিচিত। এই রাতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর নির্দেশে উর্ধ্বাকাশে গমন করেন এবং মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
ইসলামের বয়ান অনুযায়ী, মহানবী (সা.) সশরীরে সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় জিবরাইল (আ.) ও মিকাইলের (আ.) সঙ্গে বিশেষ বাহন বোরাকের মাধ্যমে মিরাজের রাতে সফর করেন। তিনি প্রথমে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। এরপর সেখানে নামাজ আদায় করেন।
এরপর সেখান থেকে ধারাবাহিকভাবে সপ্তম আসমান পেরিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এবং সেখান থেকে তিনি একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ করে মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ করেন। মহানবীর (সা.)-এর এই মিরাজ বা ঊর্ধ্বগম এমন এক সময়ে ঘটেছিল যখন তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য নিজ গোষ্ঠী ও স্বজনদের হাতে প্রচণ্ড অপমান ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন।
সূরা আল ইসরার আয়াত ছাড়াও পবিত্র কোরআনের আরও অনেক আয়াতের পাশাপাশি হাদিসে আল আকসার বিভিন্ন দিক ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে দুটি মসজিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে একটি হলো মক্কার মসজিদ আল হারাম। অন্যটি জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদ আল-আকসা।
পবিত্র কাবার আশেপাশের এলাকাকে আল হারাম বলা হয়। যেখানে বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে আল্লাহ’র পবিত্রতা ঘোষণা করেন। পবিত্র কাবাকে আল্লাহর ঘর বলা হয়। একইভাবে পবিত্র কুরআনে আল-আকসা মসজিদকে বায়তুল মাকদিসের কেন্দ্র হিসাবেও বর্ণনা করা হয়েছে, যার অর্থ ‘পবিত্র ভূমি’ এবং ‘বারাকাহ ভূমি’ বা পরিত্রাণ ও শান্তির দেশ।
পবিত্র কোরআনে আল-আকসা ও এর আশেপাশের এলাকাকে ‘বরকতময়’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইসলামি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, ‘আর্শীবাদপুষ্ট ভূমি’ শব্দের অর্থ এমন একটি ভূখণ্ড যার উপর মহান আল্লাহ বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক অনুগ্রহ দান করেছেন যেখান থেকে সমস্ত সৃষ্টি উপকৃত হতে পারে।
নবীদের ভূমি
পৃথিবীতে যেসব নবী-রাসূল এসেছেন তাদের সবার সঙ্গে মসজিদ আল-আকসার একটা সম্পর্ক ছিল। এজন্য এ মসজিদ মুসলিমদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) নিজেও আল-আকসা মসজিদের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূল (সা.) যেদিন মিরাজে গমন করেন সেদিন মক্কার মসজিদ আল হারাম থেকে মসজিদ আল-আকসায় পৌঁছানোর পর সেখানে তিনি ইমামতি করান। যেখানে সব নবী উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে সূরা বাকারার ১৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল করা হয়েছে আমাদের উপর ও যা নাযিল করা হয়েছে ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাদের সন্তানদের উপর আর যা প্রদান করা হয়েছে মুসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ হতে নবীগণকে। আমরা তাদের কারো মধ্যে তারতম্য করি না। আর আমরা তারই অনুগত।’
আল-আকসা মুসলমানদের প্রথম কিবলা
এছাড়া মসজিদ আল-আকসা মুসলমানদের প্রথম কিবলা। আল্লাহর পক্ষ থেকে কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়ার নির্দেশ আসার আগে মসজিদ আল-আকসা ছিল প্রথম কিবলা। যার দিকে ফিরে ইবাদাত করা হতো। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, তিন মসজিদ ব্যতীত অধিক নেকীর আশায় অন্য কোনো মসজিদে সফর করা যাবে না।
সেগুলো হলো মসজিদ আল হারাম (মক্কা), মসজিদ আল নববী (মদিনা) ও মসজিদ আল-আকসা (জেরুজালেম)। এজন্য বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় মসজিদ আল-আকসাকে পবিত্র ভূমি মনে করেন। এছাড়া এ মসজিদের ওপর হামলাকে ইসলামের উপর হামলা বলে মনে করেন মুসলিম সম্প্রদায়।
ফিলিস্তিনিদের কাছে গুরুত্ব
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের চেয়েও আল-আকসাকে সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র মনে করেন ফিলিস্তিনিরা। যেখানে তারা জমায়েত হয়ে আনন্দ উদযাপন করতে পারেন বা শোক করতে পারেন। ফিলিস্তিনিরা ছোটবেলা থেকে মসজিদে নিয়মিত আসেন এবং তাদের কাছে আল-আকসা দেশের সবচেয়ে স্বীকৃত প্রতীক।
ফিলিস্তিনিদের প্রথম জাদুঘর, ‘ইসলামিক মিউজিয়াম’ এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে, যেখানে বিরল প্রত্নতাত্ত্বিক ও শৈল্পিক নিদর্শন রয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে কুরআনের পাণ্ডুলিপিও।
রমজান মাসে অনেকেই মসজিদে আসেন ইফতার ও নামাজ আদায়ের জন্য এবং শুক্রবার এখানে তারা জুমার নামাজ আদায় করেন। যদিও সম্প্রতি ইসরাইলি বাহিনী নানা বিধিনিষেধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের আল-আকসায় আসা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। মসজিদটির প্রতি ফিলিস্তিনিদের যে ভক্তি ও আনুগত্য সেটাকে হুমকি হিসেবে মনে করে ইহুদি কট্টরপন্থীরা। যারা এই জায়গায় থার্ড টেম্পল বা ইহুদিদের তৃতীয় উপাসনালয় নির্মাণ করতে চায়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post