মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত, এমনকি যখন বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজারগুলোতে লক্ষাধিক বাংলাদেশী প্রবাসী কর্মহীন হয়ে বেকার ঘরে বসে দিন কাটাচ্ছেন দীর্ঘ ৩/৪ মাস যাবত। এমতাবস্থায় দেশে এসেছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে একি রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন, নাকি কেবলই প্রবাসীদের ঘরে ফেরার আয়োজন।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশ ওমানে অবস্থানকারী বাংলাদেশীদের অবস্থা বেশ শোচনীয়। শ্রমবাজারে সংকট এবং করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ওমানে কয়েক হাজার বাংলাদেশী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তারা জানান, ওমানে ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হওয়া, বাসা ভাড়া, দোকান ভাড়া, সার্ভিস চার্জ, কর্মচারীদের বেতন দেয়া এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা।
ওমানে বাংলাদেশী বেশ কয়েকজন শীর্ষ ব্যবসায়ী এবং মাস্কাট শহরে বসবাসরত বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে ওমানে যারা দীর্ঘদিন সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবসা করছিলেন তারা এখন বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে। এছাড়াও ওমানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী সালালাহ শহরের বেশ কয়েকজন প্রবাসী ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে একই চিত্র দেখা গেছে। তাদের অধিকাংশের বক্তব্য হচ্ছে, করোনার পূর্বে প্রতি মাসে অন্তত ৪-৫ লাখ টাকা উপার্জন করলেও এখন করোনার প্রাদুর্ভাবে দীর্ঘ চার মাস ধরে ব্যবসায় মন্দা ভাব। সালালাহ শহরে টেইলারিংয়ের ব্যবসা ছাড়াও মুদি দোকান, পারফিউম দোকান ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ব্যবসায় শতাধিক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাদের অবস্থা এখন শোচনীয়। তাদের একটাই বক্তব্য “বর্তমান সময়ে ব্যবসা না থাকলেও কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া ও বাড়ি ভাড়া নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে।”
ওমান থেকে কি পরিমাণ বাংলাদেশি ব্যবসায়ী করোনার কারণে ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফেরত আসবে এ বিষয়ে ওমানের একজন শীর্ষ বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতি খুবই খারাপ যাচ্ছে ওমানের ব্যবসায়ীদের, অনেকেরই দোকান ভাড়া বাকি, শ্রমিকদের বেতন বাকি সহ নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছেন তারা, সুতরাং এমতাবস্থায় কতজন ব্যবসা গুটিয়ে দেশে যাবে এটা বলা মুস্কিল এই জন্য, কারণ অনেকেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে! সুতরাং এ অবস্থায় আসলে বলা মুস্কিল কতজন ব্যবসায়ী দেশে ফেরত যাচ্ছে।”
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কাতার, ইতালি, বাহরাইন, সিঙ্গাপুরসহ দেশের প্রধান শ্রমবাজারের দেশগুলোতে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সঙ্গে কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবস্থানকারী বাংলাদেশীরা প্রবাস টাইমকে বলেছেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে চাকরি কিংবা ব্যবসা থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। ব্যয় সংকোচনের অংশ হিসেবে বিদেশী শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে। এজন্য দীর্ঘদিনের সঞ্চয় ও ব্যবসার পুঁজি দেশে পাঠানোর চেষ্টা করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুনে রেকর্ড রেমিট্যান্স আসার পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। এসব দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা দীর্ঘদিনের সঞ্চয়, ব্যবসার মূলধন ও ধার করা অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন। একক মাস হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে জুনে। গত মাসে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ১৮৩ কোটি ২৫ লাখ ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯ সালের জুনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৩৬ কোটি ৮২ লাখ ডলার। সে হিসেবে গত মাসে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। প্রবাসীদের পাঠানো এ রিজার্ভের ওপর ভর করে এক মাসেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়েছে। গত বৃহস্পতিবার (২-জুলাই) রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ১৪৪ বিলিয়ন ডলার। বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে হঠাৎ করেই রিজার্ভ বৃদ্ধির সংবাদে উচ্ছ্বসিত সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও এ উচ্ছ্বাস বেশিদিন স্থায়ী হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এই করোনার মুহূর্তে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন নিয়ে প্রবাসী গবেষক মেজর নাসির উদ্দিন আহমেদ (অব:) পিএইচডি প্রবাস টাইমকে বলেন “আসলেই এটা অনেক বড় একটা চিন্তার বিষয়, এই রেকর্ড আগামী দুইমাস পরেই বুঝা যাবে সরকারের উপর এবং দেশের উপর কি পরিমাণ প্রভাব পরছে।” কারণ হিসেবে মেজর নাসির বলেন, “এরা অনেকেই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে দেশে ফেরত আসবে বলে তাদের শেষ সঞ্চয় দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে এমনটাই মনেহচ্ছে, যে কারণে রেমিট্যান্সে হঠাত এমন উল্লম্ফন। তবে এটা নিঃসন্দেহে সরকারের জন্য একটা আগাম বার্তা। সুতরাং এমতাবস্থায় প্রবাস ফেরত ও প্রবাসে অবস্থানরত প্রবাসীদের উপর সরকারের আরও নজর বাড়ানো উচিত। অন্যথায় সামনে অবস্থা বেশ শোচনীয় হতে পারে।”
দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে। জুনে নিজেদের অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স দেশে আনতে পেরেছে ব্যাংকটি। গত মাসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৪১৪ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। এর আগে কখনই ব্যাংকটির মাধ্যমে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসেনি। ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্স আহরণের প্রধান বাজার হলো মধ্যপ্রাচ্য। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রবাসীরা বেশি অর্থ পাঠানোর কারণেই ব্যাংকটির রেমিট্যান্স সংগ্রহে উল্লম্ফন হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ ওমান প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে বিশেষ ঘোষণা
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুব উল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, অতীতে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৩৯০ কোটি ডলারের বেশি কখনই রেমিট্যান্স আসেনি। কিন্তু গত দুই মাসে আমাদের ব্যাংকের রেমিট্যান্সে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং এক মাসেই চার বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। ২ শতাংশ সরকারি প্রণোদনা বাস্তবায়ন ও হুন্ডির তৎপরতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেড়েছে বলেই মনে করছি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রবাসীরা হয়তো সঞ্চয়ের টাকাও দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
আরও দেখুনঃ প্রবাস টাইম ও সাংবাদিক হাসান নিয়ে ওমানের রাষ্ট্রদূত যা বললেন
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post